বেগম খালেদা জিয়া ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো বাংলাদেশ বিমানের জন্য ১১শ’ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১০টি নতুন আধুনিক বিমান কেনা হবে। বিমানের ফ্লিট প্ল্যান কমিটি দুই বছর সময় ব্যয় করে ২০০৩ সালের শেষদিকে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, নতুন বিমানগুলো বোয়িং কোম্পানি থেকেই কেনা হবে। বিমানের বোর্ড সভায় তা অনুমোদিতও হলো।
প্রধানমন্ত্রী পুত্র তারেক রহমান তখনও জানতেন না, বোয়িং কোম্পানি থেকে বিামন কিনলে কোন কমিশন পাওয়া যায় না। আমেরিকার ফেডারেল আইন অনুযায়ী ওই দেশের কোন কোম্পানি বিদেশে কিছু বিক্রি করার জন্য কাউকে কোন কমিশন দিতে পারবে না। চাইলে অনুদান হিসেবে দিতে পারে। ওই অনুদান আবার ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠীকে দেয়া যাবে না। ব্যাপারটা জানার পর তারেক রহমান রীতিমত চটে গেড়লেন। এত বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে বিমান কেনা হবে, অথচ কোন কমিশন পাওয়া যাবে না, তা কি করে হয়! যদি কমিশনই না পাওয়া যায় তবে আর বিমান কিনে লাভ কি? তারেক রহমান তখন সেই সময়ের বিমানের প্রতিমন্ত্রী মীর নাসিরকে বললেন, আমরা বোয়িং কোম্পানি থেকে উড়োজাহাজ কিনব না। কিনতে হলে এয়ার বাস কোম্পানি থেকে কিনবো। সব সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে আসলে ফিরে আসা সম্ভব না বলে তারেক রহমানকে জানানো হলে কপাল পুড়ে মীর নাসিরের। মা খালেদা জিয়াকে বলে তারেক রহমান মীর নাসিরকে বিমানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিলেন।
মীর নাসিরের পরিবর্তে তারেক রহমান তার অনুগত রাজাকারপুত্র মির্জা ফখরুল ইসলামকে বিমানের প্রতিমন্ত্রী পদে নিয়োগদানের ব্যবস্থা করলেন। ফখরুল প্রতিমন্ত্রী হয়েই বিমানের ফ্লিট প্ল্যান কমিটিকে নির্দেশ দিলেন, বোয়িং কোম্পানীর বিমান বাদ দিয়ে এয়ারবাস বিমান কেনার জন্য নতুন করে পরিকল্পনা করতে।
কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। এক বছরেরও বেশি সময় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যাত্রী বহনের উপযুক্ততা, সিট-মাইলের কস্ট বা মূল্য ইত্যাদি হিসাব করে তৈরি করা ফ্লিট প্ল্যান বললেই তো আর রাতারাতি পরিবর্তন করা যায় না। তবু ফ্লিট প্ল্যান কমিটি অনেক রকমের যুক্তিতর্কের উপস্থাপনা করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আপতত ৪টি বিভিন্ন মডেলের এয়ারবাস বিমান ক্রয় করার।
বিমান কেনার জন্য বিদেশী ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থাও করা হলো। কিন্তু বিদেশী ব্যাংকগুলো চাইল, বাংলাদেশ ব্যাংক কম করে হলেও উড়োজাহাজগুলোর মোট মূল্যের ১৫ শতাংশ পেমেন্টের গ্যারন্টার হতে হবে। কিন্তু বিপত্তি বাধে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সেই টাকা দিতে গরিমসি করলে।
তিনি গ্যারান্টির চিঠি ইস্যু করতে সরাসরি অস্বীকার না করে নানা টালবাহানা করে কাজটি বিলম্বিত করতে শুরু করলেন। এমনি করে কালক্ষেপণ করতে করতে বিএনপির ক্ষমতাসীন থাকার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছিল।
অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তারেক রহমান তারা বিশাল অঙ্কের কমিশন থেকে বঞ্চিত হবেন কেন। তাই তারা শুরু করলেন রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান পরিসেবা বিমান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
পুরনো ডিসি-১০ বিমান দিয়ে যে বাংলাদেশ বিমান চালিয়ে রাখা সম্ভব নয় এবং জরুরী ভিত্তিতে যে নতুন বিমান কিনতে হবে, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মির্জা ফখরুল এবং তারেক রহমান ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখলেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এক এক করে বিমানের ৫টি ডিসি-১০ বিমানের মধ্যে ৪টিই অচল করে রাখলেন। ওই সময় বিমানগুলো কিন্তু ভাল সার্ভিসই দিচ্ছিল। ৫টি বিমানের মধ্যে ৪টি বিামনকে অচল করে রাখায় বিমানের সমস্ত সিডিউল ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ল।
২০০৬ সালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন বিমানের প্রতিমন্ত্রী তখনকার কয়েকটি দিনের ফ্লাইট সিডিউলের বিপর্যয়ের খন্ডকালীন একটি চিত্র তুলে ধরছি: ২০০৬ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারী মাত্র এক সপ্তাহের চিত্র। ওই এক সপ্তাহে বিমানের ৪১টি ডিসি-১০ বিমানের ফ্লাইটের একটি ফ্লাইটও সময়মতো ছাড়তে পারেনি। মাত্র একটি ফ্লাইট অল্প বিলম্বে ছেড়েছিল। বাকি ৪০ টি ফ্লাইট অনেক বিলম্বে ছেড়েছে অথবা বাতিল হয়েছে। ওই একই সময় এয়ারবাস-৩১০ বিমানের ১১৬টি ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র ১৭% ফ্লাইট নিয়মিত সময় চলাচল করেছে। এর পরের সপ্তাহে ৫ ফেব্রুয়ারী ২০০৬ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারী ডিসি-১০ বিমানের ৬৭টি ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র একটি ফ্লাইট সময়মতো ছেড়েছিল।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সময় নিউইয়র্কে নর্থ আটলান্টিক ট্রাভেল এজেন্সি নাম দিয়ে বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি মিলে একটি সিন্ডিকেট করে। মির্জা ফখরুল বিমানের নিউইয়র্ক অফিসকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ছাড়া অন্যরা বিমানের টিকেট বিক্রি করতে পারবে না। ওই ট্রাভেল এজেন্সিগুলো নিউইয়র্ক-ঢাকা-নিউইয়র্কের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অনেক বেশি ভাড়া আদায় করত। ফলে ঢাকা-নিউইয়র্কের মধ্যে বিমানের যাত্রী কমতে শুরু করল। এক পর্যায়ে বিমানের ঢাকা-নিউইয়ের্কের ফ্লাইটই বন্ধ করে দিতে হলো। বাংলাদেশ বিমানের দুরাবস্থার সূচনাটা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই করে গেছেন। একবার যদি কোন এয়ারলাইন্সের ওপর যাত্রীরা আস্থা হারিয়ে ফেলে, তবে ওই এয়ারলাইন্স আর সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারে না।