চিরাচরিত বাংলা প্রবাদের মত বিএনপি ও তার রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলাম নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে যেয়ে নিজের নাকটাই যেন খোয়ালো। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপদে ফেলতে ২০১৩ সালে বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতের সাজানো ছকে নেদারল্যান্ডস এর হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দিয়েছিল দল দুটি।
বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের যে অভিযোগগুলো বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে করেছিল, তা নাকচ হয়েছে।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ওই আদালতের একজন প্রসিকিউটর ফাতোউ বেনসউদা সম্প্রতি এক চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছে, এসব অভিযোগের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।”
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিতদের দুটি দল জামায়াত ও বিএনপি ২০১৩ সাল থেকে নেদারল্যান্ডসের দি হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযোগগুলো করেছিল বলে জানান মন্ত্রী।
বিএনপি ও জামায়াতের অভিযোগ ছিল, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিরোধী দলের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, যা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এটি আবারও প্রমাণ হল, জামায়াত-বিএনপি ও তাদের সহযোগী গোষ্ঠী স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যাচারে লিপ্ত রয়েছে।
“বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে তাদের গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এ ধরনের অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।”
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠন করলে তখন থেকেই জামায়াত ও বিএনপি সরকার ও ট্রাইবুনালের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে।
বিএনপি ও জামায়াত আলাদা আলাদা ভাবে দুটি দলই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের জন্য লবিস্ট নিয়োগ করে। মাসে কোটি কোটি ডলারের চুক্তিও করে দল দুটি।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের নিবন্ধন তথ্য অনুযায়ী, ওয়াশিংটনভিত্তিক লবিস্ট ফার্ম অ্যাকিন গাম্প স্ট্রস অ্যান্ড ফেল্ড এলএলপিকে লবিস্ট ফার্ম হিসেবে নিয়োগ করে বিএনপি। ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আগামী নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ওয়াশিংটনের রাজনীতিকদের সঙ্গে বিএনপির সংলাপ আয়োজন, বাংলাদেশে চলমান ‘যুদ্ধাপরাধের’ বিচার সম্পর্কিত বিষয়ে লবিং, বাণিজ্য আলোচনা, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সাধারণ সম্পর্ক বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি বিএনপিকে সেবা দেবে।
বিএনপিরও বহু আগে যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে পরিচিত জামায়াত ইসলাম ২০১১ সালেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্রভাবিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট ফার্ম কেসেডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ইনকরপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে। সেখানে লেনদেন হয় বিপুল পরিমাণ ডলারের।
জামায়াতই ইসলামী সব সময় প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধীতা করে আসলেও বিএনপি ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছে আমরাও বিচার চাই তবে, কিন্তু এমন নানান শর্ত সাপেক্ষে তারা বার বার বলেছে সেই বিচার হতে হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের।
স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মান বলতে বিএনপি আসলে কোন মানদণ্ডকে বোঝাতে চাইছে এমন প্রশ্ন সাংবাদিকরা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে করলে তারা সেই প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেনি কখনো।
২০১৩ সালে বিএনপির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনারা পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে কি চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চালু রাখবেন। তিনি এর উত্তরে বলেছিলেন, এই বিচার করার এজেন্ডা বিএনপির না। তাই এই বিষয়ে জোটের সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিএনপির যে জোটে স্বয়ং যুদ্ধাপরাধীদের শীর্ষ নেতাদের অবস্থান তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তারা এই বিচার করবে তা কোন শিশুও বিশ্বাস করে না।
বিএনপি তার আন্তর্জাতিক মিত্র পাকিস্তান এবং অন্যদের সঙ্গে নিয়ে শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালায়। বিভিন্ন সময় তারা বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মুক্তি চেয়েছে। ২০১২ সালের ২৭ নভেন্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপার্সন এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গ্রেফতার নিজামী, মুজাহিদ, সাকা চৌধুরীদের রাজবন্দী বলে অভিহিত করে তাদের নি:শ্বর্ত মুক্তি দাবি করেন। এর পরে খালেদা জিয়ার দেশব্যাপী বহু সমাবেশে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে ব্যানার-ফেস্টুনসহ জামায়াত-শিবিরের উপস্থিতি চোখে পড়ার মত ছিল।
বিএনপির যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামার কারণ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চমকপ্রদ সব তথ্য। দলের একাধিক নেতার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে জানা যায় এর পিছনে লন্ডনে চিকিৎসার নামে অবস্থানরত দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। বিএনপি দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে প্রথম থেকে থাকলেও তারেক রহমানের আর্থিক লাভের দিক বিবেচনা করে যুদ্ধাপরাধীদেরকে বাঁচাতে আরো মরিয়া হয়ে উঠে দলটি।
২০০৮ সাল থেকে তারেক রহমান লন্ডনের মতো ব্যয়বহুল শহরে বিলাসী জীবন যাপন করলেও তার কোন বৈধ আয়ের উৎস নেই। তাকে ম্যানেজ করেই জামায়াত বিএনপিকে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার করতে চেয়েছে।
এই সুযোগে তারেক রহমানও বেশ মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তারেক রহমানকে দেখতে পারতো না। যখন সে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গ্রেফতার হয় তখনই তারেক রহমান এই সুযোগটি লুফে নেয়। কারণ সাকা চৌধুরী বিএনপির অঢেল সম্পদশালীদের অন্যতম একজন। তার পক্ষে বিএনপি স্বোচ্চার থাকবে বিনিময়ে তারেক রহমানকে মিলিয়ন ডলার দিয়ে খুশি রাখতে হবে এমন শর্তে বিএনপি সাকার পাশে থাকার আশ্বাস দেয়।
অন্যদিকে জামায়াত ইসলামী দলগতভাবেই অগাধ সম্পদের মালিক এবং ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীকে টাকার কুমির বলা হয়। তারেক রহমান এই সুযোগ হাত ছাড়া করেনি। মীর কাশেম আলীর পরিবার লন্ডনে একাধিকবার তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে যাতে বিএনপি জামায়াত ইসলামীর সব কেন্দ্রীয় নেতা যারা যুদ্ধাপরাধীর দায়ে গ্রেফতার এবং মীর কাশেম আলীর পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি আদায় করে। বিনিময়ে লন্ডনে তারেক রহমানের বিলাসী জীবনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। বিনিময় হয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের।