এতদিনে আর্থ ফাউন্ডেশনের নামও অনেকে ভুলে গেছেন হয়ত। যুবক বা ডেসটিনির মত ‘হায় হায়’ ফর্মূলার আদলেই গড়ে তোলা হয়েছিল আর্থ ফাউন্ডেশন। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার এক ভয়াবহ প্রকল্প চালু হয়েছিল আর্থ ফাউন্ডেশন নাম দিয়ে। যুবক, ডেসটিনি যেভাবে নানা রকম আশ্বাস, প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজেরা ফুলেফেঁপে উঠেছিল, ঠিক সেভাবে আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে প্রথম আলো পত্রিকার আনুকূল্যে আর্থ ফাউন্ডেশন মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার এক কৌশল চালু করেছিল। বলা যায়, ‘হায় হায়’ ফর্মূলার যত ব্যবসা গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে অন্যতম সফল ছিল আর্থ ফাউন্ডেশন।
২০০৮ সালে ৭৬টি ব্যবসার মাধ্যমে আর্থ ফাউন্ডেশন ৩১ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়। এই অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। যার প্রেক্ষিতে আর্থ ফাউন্ডেশনের প্রধান খান মোহাম্মদ খালেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই ধারায় আওয়ামী লীগ সরকার ডেসটিনিসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে, যারা প্রতারণামূলকভাবে বিভিন্ন কাজ করেছিল। আর্থ ফাউন্ডেশন কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের পুত্র মাহমুদুর রহমান শাসা। শাসা শুধু তার মালিকানাধীন আরেক কুখ্যাত প্রতিষ্ঠান অ্যানেক্স কমিউনিকেশনের মাধ্যমে আর্থ ফাউন্ডেশনের জন্য বিভিন্ন প্রচারণার উপকরণ তৈরি করেনি, একইসাথে আর্থ ফাউন্ডেশনকে প্রথম আলোর মাধ্যমে প্রমোটিং করানোর মাধ্যমে লভ্যাংশও পেতেন।
শাসার মালিকানাধীন অ্যানেক্স কমিউনিকেশন অনেক বড় চুক্তি করেছিল আর্থ ফাউন্ডেশনের সাথে। চুক্তির শর্ত মতে অ্যানেক্স কমিউনিকেশন বিপুল পরিমাণ ডায়েরি, ক্যালেন্ডারসহ অন্যান্য প্রচারণা সামগ্রী দেয়ার কথা আর্থ ফাউন্ডেশনকে। এ ধরণের প্রিন্টিং ব্যবসার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় শাসা তার বাবা মতিউর রহমানের দ্বারস্থ হয়। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা থাকলেও ধূরন্ধর মতি আর্থ ফাউন্ডেশনের আদ্যোপান্ত জানায় প্রথম আলোকে এর সাথে জড়াতে চাননি। তিনি দ্বারস্থ হন, তার পূর্ব পরিচিত এক প্রিন্টিং ব্যবসায়ীর। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার রণক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ মানচিত্র স্কেল অনুসারে নিখুঁতভাবে অঙ্কন করেছিলেন যিনি, সেই মোশাররফ হোসেনের প্রতিষ্ঠান গ্রাফোসম্যানের সাথে চুক্তি হয় অ্যানেক্স কমিউনিকেশনের। যার মধ্যস্ততা করেন মতি নিজেই, প্রথম আলো অফিসে। সেসময় অ্যানেক্সের সকল সভা ও চুক্তি হতো প্রথম আলো অফিসে এবং সভাপতিত্ব করতেন মতি নিজেই। অকর্মার ধাড়ি পুত্রকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মতি প্রথম আলোকে বিধি-বহির্ভূত প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করেন। এমনকি প্রথম আলোর বিজ্ঞাপনী কাজগুলোও অ্যানেক্সের নামে করিয়ে পুত্রকে ব্যবসাকে প্রসারিত করার ব্যবস্থা করেন মতি এভাবেই।

গ্রাফোসম্যানের মালিক মোশাররফ হোসেনের সাথে সাড়ে ৪ কোটি টাকার চুক্তি করেন মতি ও মতিপুত্র শাসা। চুক্তি অনুসারে যাবতীয় মালামাল সরবরাহও করা হয়। কিন্তু সরকার যখন প্রতারণার দায়ে আর্থ ফাউন্ডেশনের কর্ণধার খালেদকে গ্রেপ্তার করেন এবং সংস্থাটির কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন শাসার বিলগুলো আটকে দেওয়া হয়। আর্থ ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ দেখে প্রমাদ গোণে শাসা। আর অবস্থা দেখে ভোল বদলে ফেলেন মতি। শাসার পাওনা উদ্ধারের ভাবান থেকে প্রথম আলোতে সেসময় আর্থ ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে দু-একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এক পর্যায়ে খালেদের সাথে শাসার দফারফা হয় এবং অ্যানেক্স কমিউনিকেশনের টাকা দিতে বাধ্য হন খালেদ।
শাসা তার পাওনা বুঝে পেলেও গ্রাফোসম্যানের মালিক মোশাররফ হোসেনের এক টাকাও পরিশোধ করেনি। দিনের পর দিন পাওনা টাকার জন্য ঘুরতে ঘুরতে একপর্যায়ে মতির দ্বারস্থ হন তার পূর্ব পরিচিত মোশাররফ। প্রথম আলো অফিসে মতি তখন এমনভাবে হুমকি ধমকি দিয়ে লাঞ্ছিত করেন যে, মোশাররফ সেখানেই কেঁদে ফেলেন। মোশাররফ তখন আইনের আশ্রয় নেয়ার কথা বললে মতি তাকে অশ্রাব্য ভাষায় হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, মামলা দিয়ে তার কিছুই করতে পারবে না। সেদিনের সেই অপমানের ধাক্কা সইতে পারেননি বৃদ্ধ মোশাররফ। ব্রেনস্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হন। চিকিৎসা করানোর মত অর্থও ছিল না তার। তবুও মামলা করা হয় মতি ও শাসার নামে। কিন্তু অ্যানেক্সের কাজটি করতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন যে, চিকিৎসা এবং মামলা কোনোটাই সামাল দিতে না পেরে নিঃস্ব হয়ে যান। মামলা পরিচালনা করতে না পারায় রেহাই পেয়ে যান মতি ও শাসা। কিন্তু একটি টাকাও উদ্ধার হয়নি। সেই মোশাররফ হোসেন ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছেন নিঃস্ব অবস্থায়।
[আর্থ ফাউন্ডেশন দুর্নীতি: প্রথম আলোর প্রভাব খাটিয়ে মতি পুত্রের কেলেঙ্কারি ধামাচাপা]
এখানে বলা প্রয়োজন, শাসা কিন্তু সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে বিচারাধীন প্রতিষ্ঠান আর্থ ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে টাকাগুলো হাতিয়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, আর্থ ফাউন্ডেশন তাদের নানারকম প্রতারণার খবর ধামাচাপা দেয়ার জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বেশ ভালো অঙ্কের অনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল। যার মধ্যে প্রথম আলো ছিল অন্যতম। প্রথম আলোর সম্পাদক মতির পুত্র আর্থ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে বড় ধরনের লেনদেনে জড়িয়ে ছিল বলে মতিও অনেক অর্থ ব্যয় করেন এ সংক্রান্ত খবর ধামাচাপা দেয়ার জন্য। এমনও শোনা যায়, তিনি পত্রিকা সম্পাদকদের একটি সংগঠনের সভায় এ নিয়ে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন এ সংক্রান্ত সংবাদ যদি কেউ করে, তাদের পেছনে প্রথম আলোকে লেলিয়ে দেয়া হবে। পরে অপর পত্রিকাগুলো এ বিষয়টি এড়িয়ে যায়। সেই ঘটনার তদন্তের আর অগ্রগতি হয়নি।
প্রথম আলো সবসময় যুবক বা ডেসটিনি নিয়ে সোচ্চার ছিল। অথচ আর্থ ফাউন্ডেশন নিয়ে একবারে নীরব তারা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এর প্রধান কারণ মতিউর রহমান পুত্র শাসার সঙ্গে আর্থ ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্টতা। অন্য ক্ষেত্রগুলো যেমন- ডেসটিনি বা যুবকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যারা অনৈতিক সুবিধা নিয়েছিল, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। অথচ আর্থ ফাউন্ডেশনের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। মতি পুত্র শাসার কেলেঙ্কারি ধামাচাপাই থেকে গেছে। সেই বিচারাধীন মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি এখন পর্যন্ত। ন্যায়বিচার পাননি মোশাররফ হোসেন ও তার পরিবার। শাসার কারণে যে পরিবারটি ধূলায় মিশে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
- রোজিনা ইসলামের সরকারী তথ্য হস্তগত করার দায় স্বীকার ও কিছু প্রশ্ন
- যেভাবে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ইস্যুতে বিদেশি গণমাধ্যমে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে প্রথম আলো
- শিশুকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহারের তীব্র নিন্দা মুক্তিযোদ্ধা, কৃষিবিদ, শিক্ষক ও শিল্পীদের