সদ্য বাংলাদেশ সফরকারী জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাশেলের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী জাতিসংঘের দৃষ্টিতে মানবাধিকার বা অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ প্রকাশিত হয়নি। যে সকল দেশ ও অঞ্চলে মানবাধিকার ও মানবিক অধিকার নিয়ে সমস্যা ও উদ্বেগ রয়েছে, সেটি জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের প্রধান মিশেলের এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। সেই দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় নেই, মিশেলের প্রতিবেদনে তেমন পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে গুম-খুনের মতো বিশেষ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যে সকল দেশে বিরাজমান, সে বিষয়টিও উল্লেখিত হয়েছে। সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম আসেনি। মিশেলের প্রতিবেদনে বরং রোহিঙ্গা ইস্যুতে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক মানবাধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে প্রকারন্তরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসকল ক্ষেত্রে নানা যুগান্তকারী অর্জনকে বিশেষভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষক দলের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরকালে সরকার এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মানবাধিকার বিষয়ে যে সকল তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয়েছিল, সেগুলো তারা গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়েছেন। সেইসাথে পর্যবেক্ষক দল নিজেদের বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তগুলোর সাথে সরকারের দেওয়া তথ্য-উপাত্তের সমন্বয় করেছেন। মিশেলের প্রতিবেদনে সেটিই প্রতিফলিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের এমন প্রতিবেদনে হতাশা ব্যক্ত করেছেন বিএনপি নেতারা। দলের সিনিয়র নেতারা এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেবেন না বলে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। তবে অফ দ্য রেকর্ড তারা দাবি করেছেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সঠিকভাবে উঠে আসেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘকে ‘প্রভাবিত’ করেছেন বলে দাবি বিএনপি নেতাদের। প্রতিবেদক বিএনপি নেতাদের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা সাফ জানিয়ে দেন, জাতিসংঘ নিয়ে মন্তব্য করে বিপাকে পড়তে চাই না।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে জাতিসংঘের মহাসচিবের সাথে বৈঠক করে এসেছেন বলে মির্জা ফখরুলের মিথ্যাচার গণমাধ্যমের সামনে ধরা খাওয়ার পর থেকেই বিএনপি জাতিসংঘ ও এর সংস্থাগুলোর ব্যাপারে অনেকটাই সতর্ক।
[বাংলাদেশের মানবাধিকারের পরিস্থিতি মোটেই উদ্বেগজনক নয় – জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণে হতাশায় বিএনপি]
আগামী ৩১শে আগস্ট মিশেল ব্যাশেলের জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের প্রধান হিসেবে ৪ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হবে। এই উপলক্ষে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে গতকাল বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেখানে মূলত জাতিসংঘের দৃষ্টিতে এই ৪ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়ন ফুটে উঠেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ ছাড়াও বুর্কিনা ফাসো, নাইজার, আফগানিস্তান, চীন, বসনিয়া এন্ড হার্জেগোভিনা ও পেরুতে গিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
মিশেল তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, তার এই মেয়াদকালে পৃথিবীর মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। বৈশ্বিক কোভিড মহামারীর অপরিসীম নেতিবাচক প্রভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং ইউক্রনে যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর দেশে দেশে তীব্র খাদ্য, জ্বালানি ও আর্থিক সংকট – এই তিনটিই হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের প্রধান তিন ইস্যু। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ড প্রথা বাতিলের ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ, অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতার তথ্যও উঠে আসে। কোন কোন দেশে কী কী অগ্রগতি হয়েছে, সেকথাও মিশেল তুলে ধরেন তার প্রতিবেদনে।
আরও পড়ুনঃ সুশীলতার আড়ালে বাংলাদেশের ডানপন্থী বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকারের দোকানদারদের মুখোশ উন্মোচন
নিজের দেশে দুইবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্বের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি উল্লেখ করেন, রাষ্ট্র পরিচালনা অনেক কঠিন কাজ। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সবসময়ই নানা দাবী, সংকট ও সমস্যা থাকে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সকল সংকটই অতিক্রম করা যায়। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, মানবাধিকার সম্পর্কিত অ্যাডভোকেসি অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল আনে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় একটি মানবাধিকার কেন্দ্রিক ড্রাগ পলিসি কীভাবে সেখানকার চলমান সামাজিক- রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারে, সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
মিশেল তার ৪ বছরের মেয়াদকালে যে সকল দেশে গিয়েছেন, যে সকল মানবাধিকার কর্মী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভিক্টিমদের সাথে কথা বলেছেন, সে বিষযে একটি সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে আফগানিস্তানের নারী মানবাধিকার কর্মীদের সাহসের প্রশংসা করা হয়। মেক্সিকোর হারিয়ে যাওয়া মানুষদের মায়েদের শক্ত মনোবলের কথা বলা হয়। রিপাবলিক অফ কঙ্গোর যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের কথা বলা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন এবং অবৈধ মাইনিং এর কারণে নানা ঝুঁকিতে থাকা পেরুর আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলা হয়।
[বাংলাদেশের মানবাধিকারের পরিস্থিতি মোটেই উদ্বেগজনক নয় – জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণে হতাশায় বিএনপি]
আফ্রিকার বুর্কিনা ফাসোতে আভ্যন্তরীণ বসতিহারা (ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড) মানুষদের কথা উল্লেখ করা হয়। নাইজারের গ্রামাঞ্চলে মানবাধিকার রক্ষায় কমিউনিটি লিডারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়। ভেনিজুয়েলায় ২০১৭ সালে প্রতিবাদ সমাবেশে এক তরুণের নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। বসনিয়া এন্ড হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিসসা শহরে ২৭ বছর আগে নিখোঁজ হওয়া এক ছেলের কথা উঠে আসে। উত্তর ইউথোপিয়ায় ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা তুলে ধরা হয়। জাতিসংঘ ইয়েমেন, সিরিয়া, আফ্রিকার সাহেল এলাকা এবং হাইতিতে মানবাধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মিশেল।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কথা বিশদভাবে উঠে আসে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে এক রোহিঙ্গা শিক্ষকের সাথে কথা বলে জানতে পারেন তার স্বপ্নভঙ্গের কথা। রোহিঙ্গা হওয়ার কারণে তাকে নিজের দেশ ছাড়তে হলো। মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও মানবিক বিপর্যয়ের ফলে ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন। প্রতিবেদনে মিয়ানমারে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে দায়ী করা হয়। প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য আহ্বান জানানো হয়।
মিশেলের প্রতিবেদনে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে মানবিক বিপর্যয় হচ্ছে সেটি উল্লেখ করা হয়। ইউক্রেনের উপর সশস্র আক্রমণ বন্ধের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে অনুরোধ করা হয়। প্রতিবেদনে উভয় পক্ষ কে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনের নীতি মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হয়।
আরও পড়ুনঃ
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা এখন তলানিতে
মির্জা ফখরুলের সাইরেন ঘোষণার পরই নড়াইলে হিন্দুদের উপর তাণ্ডব
সব মানবাধিকার কি বিএনপি-জামায়াতের জন্যই? সাধারণ মানুষ ও বিএনপি-জামায়াতের ভিকটিমরা কি মানুষ নয়?