কী বলছেন একে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা, দীর্ঘদিনের সংসারে ভাঙন, নাকি তীব্র অভিমানের ফলাফল? মোটেই তা নয়। দিনভর রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলাপ-আলোচনা চলছিল যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের একটি বক্তব্য নিয়ে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের এই নেতা জানান, বিএনপির সাথে জামায়াত আর নেই। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো আসেনি। এমনকি এই প্রতিবেদক বিএনপি কার্যালয়ে গেলে দায়িত্বশীল কোনো নেতা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
যদিও অনুসন্ধানে মিলেছে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকাস্থ দূতাবাসে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে মিলিত হন। জামায়াত নেতৃবৃন্দের সাথে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সেই মতবিনিময় সভায় সিআইএ’র দুজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন বলে তথ্য মিলেছে। তবে ‘সৌজন্য সাক্ষাত’ এর নামে অনুষ্ঠিত সেই সভার বিষয়ে জামায়াত বা মার্কিন দূতাবাস কোনো অফিসিয়াল বিবৃতি দেয়নি। তবে দূতাবাসে অভ্যাগতদের এন্ট্রি বুকের সূত্রে সেদিনের অতিথিদের তালিকার একটি কপি দেশের একটি শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার হস্তগত হয়েছে ইতিমধ্যে।
আরও পড়ুন : ষড়যন্ত্রের ছক কষছে বিএনপি, সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা একাধিকবার গোপন বৈঠক করেছেন
সেই বৈঠকের কয়েকদিন পর জামায়াত নেতাদের সাথে হঠাৎ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন- বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ শুরু হয়। গত ১৪ই আগস্ট পাকিস্থানের স্বাধীনতা দিবসের দিন সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কওমি মাদ্রাসায় জামায়াতের নেতাদের সফরের খবর বেশ কিছু পত্রিকায় এসেছে। শুধু সিলেটেই ৪৩টি মাদ্রাসায় গেছেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। এসময় বিভিন্ন মাদ্রাসার ভবন নির্মাণ করে দেওয়াসহ বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তারও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এসব মাদ্রাসায় হেফাজতের মুরুব্বিদের সাথে বৈঠক করেন তিনি।
হঠাৎ কওমি আলেমদের সাথে জামায়াতের এমন মাখামাখি খোদ কওমি গোষ্ঠীর একটা বড় অংশের মাঝে অস্বস্তি তৈরি করে। হেফাজত নেতা মাইনুদ্দিন রুহী বলেন, ‘দুধ কলা দিয়ে পুষলেও জামায়াতের সাথে মিলবে না। কারণ তাদের সাথে আকিদাগত পার্থক্য রয়েছে। যার কথা আহমদ শফি সাহেবও বলতেন। জামায়াতের নীতি আদর্শের স্বীকৃতি নিয়ে অনুদান দিতে চাইলে কওমী আলেমরা তা প্রত্যাখ্যান করবে।’ যদিও জানা গেছে, কওমি মুরুব্বিরা জামায়াত আমিরের অনুদান হাত পেতেই নিয়েছেন। হেফাজত নিয়ন্ত্রণাধীন কওমি মাদ্রাসাগুলোর উন্নয়নের জন্য জামায়াতের ২০ কোটি টাকার ফান্ড গঠনের তথ্যও মিলেছে অনুসন্ধানে।
হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত আমির আহমদ শফী চিরকাল জামায়াতের বিরোধিতা করেছেন। কওমিপন্থীদের আকিদার সাথে জামায়াতের আদর্শের আকাশ-পাতাল ফারাক থাকায় এই বৈরিতা। তবে পাকিস্থানে দীর্ঘকাল পড়াশোনা করে আসা এবং উগ্রবাদীদের সাথে মেলামেশা থাকায় হেফাজতের প্রয়াত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী ও মামুনুল হকদের সাথে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের সুসম্পর্ক সবসময়। সেজন্য তারা হেফাজতের ভেতরে বিরোধ ঘটিয়ে আহমদ শফীকে পরপারে পাঠায়। হাটহাজারী মাদ্রাসায় ভাঙচুরকারীরা ছিল জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার, এটা শফীপুত্র আনাস মাদানীর নিজের বক্তব্য।
মূলতঃ যুদ্ধাপরাধী নেতাদের ফাঁসির পর সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া জামায়াতের পুনরুদ্ধারে হেফাজতের মত আর্থিক, সাংগঠনিক এবং কর্মীসংখ্যায় শক্তিশালী একটি দলকে নিজেদের সাথে একীভূত করার চেষ্টা করছিল জামায়াত দীর্ঘদিন ধরেই। সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক রাখায় বাংলাদেশের ওপর নাখোশ পশ্চিমা বিশ্ব। মানবাধিকারের দোকানদারদের সহায়তায় বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। এমন একটা স্পর্শকাতর সময়ে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে ৭৫-এর পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায় সিআইএ’র নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক কুচক্রী মহল। মার্কিন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পরামর্শে দল গোছানোর চেষ্টা করছে জামায়াত। তাই নিজস্ব লোক ঢুকিয়ে হেফাজতকে গত কয়েক বছর ধরে নেপথ্য থেকেই পরিচালনা করছিল সংগঠনটি।
বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিজেদের ঘাঁটি বানানো এবং হেফাজতের তৃণমূলের নেতাদের মাঝে ক্ষমতার অভীপ্সা তৈরির মাধ্যমে নিজেদের সাথে একীভূত করার চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত- দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে এমন কিছু তথ্য এসেছে সম্প্রতি। বিএনপি নেতৃত্বশূন্য হওয়ায় বাংলাদেশে জামায়াতকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ঘটাতে চায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। ইতিমধ্যে সিআইএ’র উইং এনইডি’র কাছ থেকে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য কোটি কোটি টাকা পেয়েছে তাসনিম খলিল ও বার্গম্যানের মালিকানাধীন ‘নেত্র নিউজ’; যা খলিল নিজেই তার ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন। জামায়াতের পেছনেও কাজ করছে এনইডি’র একটি টিম, এমনটাই জানা গেছে গোয়েন্দা সূত্রে।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই জেনেও নিবন্ধন হারানো ও যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে একচুলও সরেনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কাঁধে ভর করে, বিএনপির প্রতীক নিয়ে জামায়াতের নেতারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তাই দল হিসেবে জামায়াত নির্বাচনে যেতে না পারলেও সংসদে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠানোর ক্ষেত্রে তারা বিএনপির ওপর নির্ভরশীল। বিএনপি ছাড়া জামায়াতের কোনো গতি নাই। আবার অরাজনৈতিক সংগঠন হওয়ায় হেফাজত নির্বাচনে অংশ নিবে না। তাই কওমিগোষ্ঠীকে নির্বাচনে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে বিএনপির প্রতীককে সম্বল করে জামায়াত তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কথা ভাবছে। এসব বিষয়ে অনুসন্ধানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে।
বিএনপির নেতৃবৃন্দের বিদেশি দূতাবাস ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের সাথে গত কয়েক বছর ধরে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। যুদ্ধাপরাধী এবং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত বলে জামায়াতের সাথে বিএনপির জোট বাঁধার বিষয়টি অনেকদিন ধরেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ছে। জামায়াতকে ত্যাগ করার জন্য ইউরোপিয় ইউনিয়নের চাপ ছিল বিএনপির ওপর। কিন্তু দলের পলাতক নেতা তারেক রহমানের আপত্তির কারণে বিএনপি জোটের শরিক জামায়াতকে ছাড়তে পারছিল না। তবে এবার সিআইএ’র বুদ্ধিতে স্ট্র্যাটেজি বদলের দিকে হাঁটছে বিএনপি। তাই জামায়াতকে দিয়ে বলানো হলো, তারা আর জোটে নাই।
জামায়াত একদিকে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করছে হেফাজতকে সাথে নিয়ে, অন্যদিকে বিএনপি তাদের নাটকের অন্য অংশটি চালিয়ে যাচ্ছে মিডিয়ার সামনে। মূলত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং বিদেশি দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তাদের সামনে নিজেদেরকে নিষ্কলুষ সাজাতে বিএনপি-জামায়াতের এই তালাক নাটকের সৃষ্টি। জামায়াত সন্ত্রাসী সংগঠন, তাই আমরা তাদের সাথে নাই- এটাই বিএনপির বক্তব্য। ঘোষণাটা জামায়াতকে দিয়েই দিয়েছে বিএনপিই। জামায়াতের আমির তার বক্তব্যে বলেছেন- ‘আমরা তাদের (বিএনপি) সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি, তারা ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা আর কোনো জোট করবে না।’
আরও পড়ুন : দেশকে অস্থিতিশীল করার ব্লু প্রিন্ট বিএনপি-জামায়াতের
শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, বিএনপি চায় না জোট করতে। এতে স্বেচ্ছায় জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার বার্তাটি বিএনপি দিতে চায় বিদেশি প্রভুদের। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে পারলেই বিএনপিকে গুরুত্ব দিবে ইউরোপিয় ইউনিয়ন- এমন ইঙ্গিত দিয়েছে মার্কিন সংস্থা- এনইডি’র এজেন্টরা। জানা গেছে, জামায়াতের নেতারা আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে আরেক মার্কিন দালাল রেজা কিবরিয়া ও নুরুর নেতৃত্বাধীন অধিকার পরিষদ, বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ব্যানারে এনইডি’র ফান্ডেই নির্বাচন করবে তারা।
কিছুদিন আগে সিআইএ’র দালাল রেজা কিবরিয়া আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটা জামায়াত নেতাদেরকে আমলে নিয়েই। ‘জামায়াত-বিএনপি একই মায়ের পেটের দুই ভাই’- বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানার এই বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য। বিচ্ছেদ দেখানো হলেও সেটা মূলত একটা নাটক, এখন যা স্পষ্ট। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং তাদের রাজনৈতিক উইং এনইডি’র বুদ্ধি-পরামর্শেই এই কৌশল করেছে দল দুটি।
[অনুসন্ধান : একটি বিশেষ দূতাবাসের পরামর্শেই ইইউকে ধোঁকা দিতে বিএনপি-জামায়াতের বিচ্ছেদ নাটক!]
বিদেশিদের ধোঁকা দিয়ে আখের গোছাচ্ছে এই দুর্বৃত্ত দল দুটি। লক্ষ্য একটাই, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে ৭৫-এর মত একটা ক্যু ঘটানো। এরপর ক্ষমতা দখল করে চীন ও রাশিয়া-বিরোধী শক্তির উত্থান ঘটানো তাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশ হবে তাদের হাতের পুতুল, সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর বহুদিন ধর কুদৃষ্টি রয়েছে মার্কিনিদের। স্ট্র্যাটেজিক্যালি এই অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটি তৈরির জন্য সেটাই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। এই লক্ষ্যই কূটচাল চালছে মার্কিন মকুনেরা। অতএব, এই দেশবিরোধী চক্র হতে সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।
আরও পড়ুন :
- গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে জামায়াত, গোয়েন্দা নজরদারি শুরু
- বিএনপি আবারও প্রমাণ করলো তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, ক্ষমতা দখলের লোভে জামায়াতকে পাশে চায় বিএনপি
- ২০১৭’র জুলাইতে খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরের উদ্দেশ্য ছিল আইএসআই’র সাথে গোপন বৈঠক