১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা আরেকটি ন্যাক্কারজনক ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবৈধ সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, ঠিক একইভাবে ২১ আগস্টেও তার পরিবারের সংশ্লিষ্টতা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত, বিচার ও সাক্ষ্যপ্রমাণে পাওয়া যায়।
২০০৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী। ২১ আগস্টে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেই এই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। যুদ্ধে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড দিয়ে দিনের আলোয় হামলা চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর ৩রা নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকেও নৃশংসভাবে কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। এই সব বর্বর হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তি মানুষকেই হত্যা নয় পাশাপাশি দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে পরিচালনা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ২১শে আগস্টের হত্যাকাণ্ডে খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা
২১শে আগস্ট ট্রাকে দাঁড়িয়ে সেদিন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ প্রায় ২ ঘণ্টার মতো বক্তৃতা দিয়েছেন। পরে ৫টা ০২ মিনিটে সভার প্রধান অতিথি, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুরু করেন। বক্তৃতা করেছিলেন প্রায় ২০ মিনিট, সময় তখন বিকেল ৫টা ২২ মিনিট। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগুতে থাকলেন ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির কাছে। মুহূর্তেই নারকীয় গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড।

সে এক ভয়াল অবস্থা। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১২টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আওয়ামী লীগ মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আইভী রহমানসহ আরও ১১ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।নারকীয় সে হামলায় নিহত-আহতদের চিকিৎসায় কোনও সহযোগিতা করেনি জোট সরকার। পুলিশ বাহিনী কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর লাঠিচার্জ করা হয়। আহত রক্তাক্ত হাত-পা হারানো মানুষগুলোকে কোনও সাহায্য-সহযোগিতা না করে উল্টো টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করা হয় যাতে ঘাতকরা সহজে পালিয়ে যেতে পারে। এমনকি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড উদ্ধার করা হলেও আলামত নষ্ট করতে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ঘটনাস্থলের সকল আলামত নষ্ট করে ফেলা হয়। হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজে বাঁচতে ও অন্যদের বাঁচাতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলের ওপর বেধড়ক লাঠি-টিয়ার শেল চার্জ করে। একইসঙ্গে নষ্ট করা হয় সেই রোমহর্ষক ঘটনার যাবতীয় আলামত। আহতরা যেন চিকিৎসা না পান সেজন্যও উপরের নির্দেশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকদের অলিখিত নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছিল। হামলার পর অগণিত আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে নেওয়া হলেও মূল প্রবেশদ্বার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: ১৭ আগস্ট ২০০৫ : বিএনপি জামাত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে সারাদেশে জেএমবি’র সিরিজ বোমা হামলা
বিএনপি-জামায়াত সমর্থক ড্যাবের ডাক্তাররা সেদিন চিকিৎসা দিতে আসেনি। ফলে আহত বেশিরভাগ নেতাকর্মী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল।পরদিন সন্ধ্যার আগেই পোস্টমর্টেম শেষ হলেও নিহতদের লাশ গভীর রাতের আগে স্বজনদের দেওয়া হলো না। গায়েবানা জানাজার পর শোক-মিছিলেও হামলা করলো পুলিশ এবং বিএনপির ক্যাডাররা।ঘৃণিত গ্রেনেড হামলা থেকে কোনোভাবে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারেন, তার সব চেষ্টায়ই করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাঁচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের আঘাতের দাগ, গ্রেনেড ছুড়ে মারার চিহ্ন এবং বুলেটের আঘাতে পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির দুটি চাকা সে কথাই প্রমাণ করে। এটি ছিল একেবারে ঠাণ্ডামাথায় হত্যার পরিকল্পনা। তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থাসম্পন্ন মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটিই সেদিন শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছিল।গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা সমগ্র বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত করেছিল। তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু গ্রেনেড হামলার ঘটনায় সংসদে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি, বিএনপির এমপিরা সরাসরি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে অভিযোগ করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। খুনিদের মিশন শেষ করার সব ব্যবস্থা করে পরের দিন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর বলেছিলেন, উই আর লুকিং ফর শক্রস্। সরকারের মন্ত্রী এমপিরা এও বলেছিল, শেখ হাসিনাই নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে হামলা করেছিল।
খালেদা জিয়া নিজে সংসদে বলেছিলেন, “উনাকে (শেখ হাসিনাকে) মারবে কে”। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও ফলাও করে প্রচার করা হয় যে, আওয়ামী লীগ নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল।১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর অবৈধ সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও পরবর্তীতে তার স্ত্রী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যেভাবে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষা ও পুনর্বাসন করেছিলেন তেমনিভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট চেষ্টা করেছে ২১ আগস্টের খুনিদের রক্ষা করতে। হামলাকারীদের একজন মওলানা তাজউদ্দিনকে পাকিস্তান পাঠানো হয়।সাক্ষী হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে রুমি বলেন, ‘তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আগে থেকেই সবকিছু জানেন বুঝতে পেরে আমি কথা না বাড়িয়ে সেদিন তার অফিস ত্যাগ করেছিলাম।’
[জিয়াউর রহমান যেমন ১৫ আগস্টের মাস্টারমাইন্ড, তার পুত্র তারেক রহমান তেমনই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাস্টারমাইন্ড]
জেনারেল রুমি উল্লেখ করেন, হামলার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী মাওলানা তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী নিজে নিরাপদে বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা সঠিক কিনা তিনি তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করলে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বেগম খালেদা জিয়া তাকে বলেন, ‘কোথা থেকে তুমি এই উদ্ভট তথ্য পেয়েছ। তাজউদ্দিন পাকিস্তানে না কোথায় গেছে সে ব্যাপারে তোমার মাথাব্যথা কেন?’ (সূত্র: দৈনিক সমকাল ২৩.৮.২০১২)সাবেক গোয়েন্দা প্রধান বলেন, গ্রেনেড হামলার খবর পেয়েই তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জানানোর চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন: হাওয়া ভবন মাফিয়া সিন্ডিকেটের শতাধিক সদস্যেরা কে কোথায়?
কিন্তু টেলিফোনে তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে ফোন করেন। হারিছ অচেনা স্বরে তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দেন এবং ঘটনাটি ব্যাখ্যা করে বলার আগেই ফোনটি কেটে দেন। সাবেক ডিজিএফআই প্রধান বলেন, পরে তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে ফোন করেন। কিন্তু ঘটনা জানেন বলেই তিনিও ফোনটি কেটে দেন। (সূত্র: দৈনিক সমকাল ২৩.৮.২০১২ ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসস)হাওয়া ভবনে তারেক রহমান, যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর নূর, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, আবদুস সালাম, হানিফ পরিহনের মালিক হানিফসহ বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতা এবং মুফতি হান্নানসহ শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের কয়েকদফা বৈঠকে গ্রেনেড হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেছিলেন। হাওয়া ভবনেই হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বৈঠকও হয়। পরবর্তীতে যা মুফতি হান্নানসহ আটজন আসামির আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সত্য বেরিয়ে আসে।
আরও পড়ুন:
- বাংলাদেশের গণতন্ত্র সর্বনাশ করেছিল জিয়াউর রহমান
- ৭৫ এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার: রাজনৈতিক ছদ্মবেশে একদল সিরিয়াল কিলার
- খুনি তারেকের এবারের টার্গেট আগস্ট মাস!