মির্জা ফখরুলের সাইরেন ঘোষণার পরই নড়াইলে হিন্দুদের উপর তাণ্ডব

0
162
মির্জা ফখরুল

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, সরকারের পতনের সাইরেন বাজতে শুরু করেছে। শুধু তিনি একা নন, তার দলের অপর নেতারাও হঠাৎ করে ‘সাইরেন সাইরেন’ রব তুলেছেন গতকাল থেকেই। আমরা জানি, সাইরেন বাজানো হয় বিপজ্জন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে। যুদ্ধকালীন সময় বিমান হামলা বা প্রতিপক্ষের গোলাবর্ষণ কিংবা আক্রমণ শুরু হলে বেসামরিক জনগণকে সতর্ক করতে সাইরেন বাজানো হয়। সাইরেন শুনে তখন প্রাণ বাঁচাতে লোকজন দিকবিদিক দৌড়াতে শুরু করেন। একটা ভয়ানক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির অবতারণা হয় তখন।

বিএনপির নেতারা দেশকে তেমনই এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন অনেকদিন ধরেই। প্রায়শঃ তাদের এমন পরিকল্পনা দেখা যায়। কখনো নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রতিপক্ষের সমর্থকদের (রাজনৈতিক কর্মী হোক বা সংখ্যালঘু) ওপর হামলা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণসহ বিভিন্ন রকম নিপীড়ন করেন তারা, কখনো প্রতিপক্ষকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে তাদের ওপর গ্রেনেড হামলা করা হয়, কখনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়, কখনো গণপরিবহন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করে জঘন্য কর্মকাণ্ড ঘটায় বিএনপি।

গতকাল থেকে বিএনপির ‘সাইরেন সাইরেন’ রব ওঠার পর হঠাৎ করে নড়াইলে ঘটে যায় এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এবারও লক্ষ্যবস্তু সেই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। যারা মূলত সরকারদলীয় ভোটব্যাংক হিসেবে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি-জামায়াতের চক্ষুশূল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যে কোনো উছিলায় তাদের ওপর হামলে পড়ে বিএনপি-জামায়াত জোট এবং হেফাজতের জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা। আহমদ শফী এবং জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলাম এখনো জামায়াতের ভাড়াটে গুন্ডা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই তিন গোষ্ঠীই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের চিরশত্রু বলে বিবেচিত।

নড়াইলে হিন্দুদের ওপর তাণ্ডব

নড়াইলের লোহাগড়ায় ইসলাম অবমাননার ধুয়া তুলে দিঘলিয়া বাজারের হিন্দু মালিকানাধীন ৬টি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে- নিত্য দুলাল সাহা, অনুপ সাহা, অশোক সাহা, সনজিৎ সাহার মুদি দোকান এবং গোবিন্দ কুণ্ডু ও গৌতম কুণ্ডুর মিষ্টির দোকান। একইসাথে কয়েকটি বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ ঘটনা ঘটে। সাহাপাড়ার কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। গৌর সাহা, চায়না রানী সাহা, বিপ্লব সাহার বাড়িঘর ও আসবাবপত্র ভাঙচুরসহ এবং স্বর্ণলংকার ও নগদ টাকা নিয়ে যায়। নাড়ূ গোপালের বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। পরে আখড়াবাড়ী সার্বজনীন পূজামণ্ডপে আগুন ধরিয়ে দেয় ইসলামপ্রিয় তৌহিদি জনতা। যারা মূলত স্থানীয় জামায়াত-শিবির ও বিনএপির নেতা-কর্মী বলে দাবি এলাকাবাসীর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে পুলিশ ও র‍্যাব মোতায়েন রয়েছে।

বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ‘সাইরেন বাজানোর’ পরেই এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার কিছুক্ষণ আগে একটি হিন্দু নামধারী ফেসবুক আইডি থেকে দেওয়া ‘অবিশ্বাস্য’ ধরণের উস্কানিমূলক পোস্টের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। স্ক্রিনশটটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যখন এই স্ক্রিনশট নেওয়া হয়েছে, তখন সেখানে কোনো লাইক রিঅ্যাকশন বা কমেন্টও ছিল না। অর্থাৎ, কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে পোস্ট পাবলিশ হওয়ার সেকেন্ডের মধ্যেই তাৎক্ষণিক স্ক্রিনশটটি নিয়ে ছড়িয়ে দেয়। এলাকাবাসীর মতে, পোস্টে যে ধরণের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী এমন দুঃসাহস দেখাবে না। যেখানে নিত্যই ধর্ম অবমাননা বিষয়ক নানা হামলার ঘটনা ঘটছে দেশে।

আরো পড়ুনঃ নড়াইলে ফেসবুক পোষ্টকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা

এই স্ক্রিনশট এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার পরেই হামলার ঘটনাগুলো ঘটে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ‘সাইরেন বাজানোর’ পরপরই এমন ঘটনা ঘটা- দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র দেখছেন অনেকেই। তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে, প্রশাসন সতর্ক থাকায় এবং পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি খুব বেশিদূর গড়াতে পারেনি।

নড়াইলের পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাতত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

পুলিশ পরিদর্শক হারান চন্দ্র জানান, ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসকে ঘিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক তরুণের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের পর এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুদ্ধ জনতা কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। মন্দিরে ইট ছোড়ে। তারা একটি বাড়িতে আগুন দেয়। আমরা গিয়ে নিভিয়ে ফেলি এবং ফাঁকা গুলি করে ছত্রভঙ্গ করি।

সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বিএনপি ত্রাসের রাজত্বের ইতিহাস:

২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি এবং জামায়াত জোট হিন্দুদের ওপর যে আক্রমণ করে তা এক বিভীষিকা। শুধুমাত্র বিভিন্ন পত্রিকা ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য থেকে কিছুটা ধারণা দেওয়া যাক।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন মতে, ২০০১ সালের ১লা অক্টোবরের পূর্বেই বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে ভোট না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি। নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট একের পর এক হামলা করতে শুরু করে। কারণ তারা দেখেছে, হিন্দু ভোটারেরা আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়েছে যথারীতি। নির্বাচনের পরের অবস্থা ছিলো আরো পরিকল্পিত, ছকবদ্ধ এবং গুরুতর। সেসময় বিএনপি জোটের হামলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিলো- বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, কুমিল্লা ও নরসিংদী। ওই সময় আক্রমণকারীরা হিন্দুদের বাড়িতে ঢুকে তাদের পরিবারের সদস্যদের মারধর, তাদের সম্পত্তি লুটপাট, দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং অনেক হিন্দু নারীদের ধর্ষণও করে।

সেসময় সহিংসতা এবং ভয় দেখানোর প্রধান উপায় হিসেবে ‘ধর্ষণ’ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মতে, সেসময় কমপক্ষে ১৮৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুসারে, এসব ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মীরাই দায়ী। সেসময় কয়েকজন হিন্দু নারীকে অপহরণও করে তারা। অপহৃতরা পরবর্তীতে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন কি না তা এখনও অজানা। নিরাপত্তার শঙ্কায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো মুখ খুলতে সাহস করেনি।

আর এসব হামলা এবং জীবনের ওপর হুমকির কারণে ওই সময় হাজার হাজার হিন্দু পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যান। এমনকি দূরবর্তী আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়েও আশ্রয় নেন কেউ কেউ। সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকারে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভুক্তভোগীরা বলেছেন, ভোটে হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগের সমর্থক ধরে নিয়ে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন হিন্দুরা। সেসময় হিন্দুদের অনেক মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়।

কানাডার ইমিগ্রেশন এবং শরণাথী বোর্ডের গবেষণা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর বাংলাদেশে নির্বাচনের সময়কালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার ঘটনাগুলো বিবিসি (১০ই অক্টোবর ২০০১), গাল্ফ নিউজ (১২ই ফেব্রুয়ারী ২০০২), প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (২০শে অক্টোবর ২০০১), এবং প্যাক্স ক্রিস্টি (২৬শে নভেম্বর, ২০০১) ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

আরো পড়ুনঃ ফেইসবুকে ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগে নড়াইলে হিন্দু বাড়িতে আগুন

এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনাগুলোতে ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা ও লুটপাটের পাশাপাশি হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সহিংসতার শিকার হয়ে হাজার হাজার হিন্দু পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। দ্য ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়য়েন্স জানায়, বেশিরভাগ সহিংসতা বিএনপির কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত হয়… হিন্দুদের ওপর আক্রমণগুলো সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় ঘটেছে।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর বিএনপি-জামায়াতের হামলার খবর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টর আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদন ২০০৫-এ প্রকাশ পায়। সেখানে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্তৃক হিন্দুদের ওপর সহিংস আচরণ করা হয়েছে, কারণ ঐতিহ্যগতভাবেই তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, লুট এবং নির্যাতনের কথা উল্লেখ ছিল।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘদের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। আর এ কারণেই বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মন্দির এবং গির্জায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি প্রয়েজন পড়ে। প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, প্রার্থনার স্থানে হামলা, ঘরবাড়ি নষ্ট, জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং উপাসনার সামগ্রী নষ্ট করার বিষয়গুলো। ঘটনাস্থল এবং সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের বক্তব্য প্রতিবেদনে রয়েছে।

আরো পড়ুনঃ সারাদেশে সংখ্যালঘু আক্রমনের নেপথ্যে বিএনপি!

বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগের তদন্ত অনুযায়ী, দেখা গেছে বিএনপি এবং জামায়াতের ২৬ হাজার ৩৫২ জন নেতা এবং সমর্থকের ওই দাঙ্গায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয় গেছে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২৬ জন মন্ত্রী এবং আইনপ্রণেতারা রয়েছেন। অভিযুক্ত ৬ মন্ত্রী হলেন: রহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আবদুস সালাম পিন্টু, মতিউর রহমান নিজামী, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, তারিকুল ইসলাম ও হাফিজউদ্দিন। তাদের মধ্যে, আলতাফ হোসেন চৌধুরী খোদ তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।

অতএব, ইতিহাস এবং বর্তমানে নির্বাচনের পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর প্যাটার্ন লক্ষ্য করলে এটা বোঝা যায়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নোংরা খেলার গুটি বানানো হলে লাভটা আসলে কাদের, সাইরেন বাজিয়ে দেশে যুদ্ধ লাগাতে তৎপর কারা, এই দেশকে ব্যর্থ করে দিতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে কোন গোষ্ঠী? উত্তরটা পেতে হলে রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নাই।

comments

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here