বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সাড়ে সর্বনাশ হচ্ছে- বলে সারাক্ষণ আওয়াজ তোলা বিএনপি জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ-না ভোট নিয়ে জনসম্মুখে কথা বলতে নারাজ। গণমাধ্যম-টিভি টকশোতে গণতন্ত্রের বুলি আউড়ানো দলটির জন্মই যেনো আজন্ম পাপ। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে তা পাকাপোক্ত করতে ন্যাক্কারজনকভাবে হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করেন জেনারেল জিয়া। লোক দেখানো সেই হ্যাঁ/না ভোটে হয়নি কোনো মিছিল-মিটিং।সেসময়ে রাস্তাঘাটে রিকশা-বাসে এবং মানুষের ব্যক্তিগত যানবাহনে জেনারেল জিয়ার সামরিক পোশাক পরিহিত পোস্টার জোর করে সাঁটিয়ে প্রচারণার নামে একধরণের আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। ভোটের দিন ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্রে মানুষ খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত অনেক শিশুকেও জোর করে ভোট দিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের সূত্র মতে, ১৯৭৭ সালে ৮৮.৫০% ভোটার ভোট দিয়েছেন। উপস্থিত ভোটারের মধ্যে ৯৮.৯% ভোটার ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছেন!এই নির্বাচনে জিয়াউর রহমান কোনো কোনো এলাকায় ১২০ ভাগ ভোট পেয়েছেন বলেও বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ভোটার উপস্থিতির এমন বিপুল হার উপমহাদেশের আর কোনো নির্বাচনে হয়েছে কি না তা জানা যায়নি।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জিয়াউর রহমান আয়োজন করেছিল গণভোটের, অর্থাৎ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকবে না। সামরিক কায়দায় ক্ষমতা হাতানোর এই প্রক্রিয়া অবশ্য জিয়াউর রহমানের আবিষ্কার নয়, এর প্রবক্তা আইয়ুব খান—জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানকে অনুসরণ করেছিল মাত্র।এই রাজনৈতিক পাপ প্রতিষ্ঠা করতে জিয়াকে আরও কিছু আয়োজন সম্পন্ন করতে হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সরকারি আদেশে পনেরোই আগস্টের খুনিদের মধ্যে মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রাশেদ চৌধুরী ও মেজর নূরকে সেনাবাহিনীর চাকরিতে ফিরিয়ে এনেছিলেন।ফারুক ও রশিদ ছাড়া সবাইকে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনে চাকরি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় টিকে থাকবার জন্য। এরপর সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে বেসামরিক প্রশাসনের লাগাম হাতে নিতে জিয়াউর রহমানের খুব বেশি সময় লাগেনি।
জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেই এক সামরিক ফরমান জারি করে তিনি নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক তো ঘোষণা করেছিলেনই, আবার নিজেই আরেক ফরমান জারি করে ঘোষণা দেন তিনি দেশের ‘প্রেসিডেন্ট’। কে তাকে প্রস্তাব দিল? কে তাকে ভোট দিল? কোনো কিছুরই প্রয়োজন পড়ল না! শুধু সামরিক ফরমান জারি করে বলেছিলেন, ‘এখন থেকে তিনিই দেশের প্রেসিডেন্ট’।২৯ নভেম্বর ১৯৭৬ সেনাপ্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকা বিচারপতি সায়েমকে অস্ত্রের মুখে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।
১৯৭৭ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান একা ‘প্রেসিডেন্ট প্রার্থী’ হয়ে ‘হ্যাঁ কিংবা না’ ভোট দেন। কিন্তু এককভাবে নির্বাচনে প্রার্থী বিষয়ে গণতন্ত্রের প্রশ্ন ছাড়াও বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর যে বিধিমালা রয়েছে তাতেও তিনি প্রার্থী হতে পারেন না। বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট ২৯২ ও ২৯৩ বিধিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য তার চাকরির মেয়াদ শেষ না হতে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল জিয়াউর রহমান একই সাথে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি থাকার জন্য একটি সামরিক ফরমান জারি করেন। দেশের সংবিধান, আইন-কানুন, সামরিক বাহিনীর বিধি অবৈধভাবে বারবার নিজের স্বার্থে পরিবর্তন এবং জারি করেছেন জিয়াউর রহমান।