জেনারেল টিক্কা খান, এক কসাইয়ের নাম, যার নাম শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে রক্ত এক পিপাসু দানবের অবয়ব। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে গণহত্যা চালানোর জন্য তাকে ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ নামে ডাকা হতো। পরবর্তীতে, বাঙালি জাতির ওপর নিপীড়ন চালানোর জন্য পাকিস্তানের স্বৈরাচার ইয়াহিয়া খান তাকে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর ও পূর্বাঞ্চলের সেনা কমান্ডার করে পাঠান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, টিক্কার নেতৃত্বেই ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি জান্তারা হামলে পড়ে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই বর্বর হামলার নেতৃত্ব দেয় সে। এরপর লে. জেনারেল এ কে নিয়াজিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় জোনের কমান্ডার করা হয়।
দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর অবশেষে পরাজিত হয় তারা। পাততাড়ি গুটিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায় পাকিস্তানি জান্তারা। ব্যর্থতার দায়ে জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বিচারের মুখোমুখি করা হয় সেখানে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেয় পিপলস পার্টির নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টোর অধীনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয় টিক্কা খান। পরবর্তীতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে জেনারেল জিয়াউল হক। ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলায় সে। কিছুদিন জেলের থাকার পর, বের হয়ে পিপলস পার্টিতে যোগ দেয় টিক্কা খান। ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টোর শাসনামলে পাঞ্জাবের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পায় এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। ঠিক এরকম একটি সময়ে দুজন বাঙালি সাংবাদিকের মুখোমুখি হয় সে। তার কথায় উঠে আসে পাকিস্তানিদের গণহত্যা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ।

১৯৮৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর, পঞ্চম সার্ক সম্মেলনের অনুষ্ঠান শেষে, সাংবাদিক রেজাউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে পাঞ্জাবের গভর্নর হাউসে যান সাংবাদিক মুসা সাদিক। তাদের কাছে দেওয়া দুই ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে কোনো রাখঢাক না করেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে টিক্কা খান। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা বাঙালিদের ওপর গণহত্যা ও ধর্ষণের ঘটনার দায় শিকার করেছে। তবে এসব জঘন্য ঘটনার জন্য মূলত বাংলাদেশের পাকিস্তানি দোসরদের (রাজাকারদের) দায়ী করেছে টিক্কা খান।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গে টিক্কা খান বলেছে, ”আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল- ‘স্যার, শুনুন! শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন।’ এবং আমি নিজেও রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি। শেখ সাহেবের কণ্ঠ আমি ভালো করেই চিনতাম। শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।”
বঙ্গবন্ধুর অদম্য সাহস ও নেতৃত্বগুণের প্রশংসা করে সে আরো বলেছে, ‘আমি ভালো করেই জানতাম, শেখ মুজিবের মতো নেতা তার নিজের লোকদের ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আমি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার জন্য ঢাকার সব জায়গায়, প্রতিটি বাড়ি-ঘরে, এমনকি প্রতিটি কোণায় কোণায় তল্লাশি চালাতাম। অন্য কোনো নেতাদের গ্রেফতার করার ইচ্ছা ছিল না আমার। এজন্য তারা খুব সহজেই ঢাকার বাইরে চলে যেতে পেরেছিল।’
আরও পড়ুনঃ How Bangabandhu prepared the nation for armed revolt throughout March
[শত্রুর চোখে বঙ্গবন্ধু – শেখ মুজিব বাঙালিকে গোলামি থেকে মুক্তি দিয়েছে: টিক্কা খান]
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর প্রসঙ্গে টিক্কা জানায়, ‘আমি তাকে কখনো ছোট করে দেখিনি। সব সময় বড় মাপের নেতা হিসেবে দেখেছি। বেয়াদবি হয়ে যাবে ভেবে তার চোখে চোখ রেখে কখনো কথা পর্যন্ত বলিনি। স্যার, স্যার বলে আদবের সঙ্গে কথা বলেছি। এমনকি ১৯৭৪ সালে উনি যখন ওআইসি-এর সম্মেলনে আসেন, তখনও বিমানবন্দরে আমাদের সচিব ও জেনারেলরা তার সামনে নত হয়ে কথা বলেছি। লাহোরবাসী তাকে উচ্চ সম্মান ও সমাদর করেছে এবং লাখো নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে তার যাতায়াতের পথে ফুল ছড়িয়ে দিয়েছে।’
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও বাংলাদেশের কিছু লোক পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছিল এবং তাদের নির্দেশনাতেই গণহত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলেও জানায় সে। ১৯৮৮ সালে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে টিক্কা খান বলেছে, ‘বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা আমাদের সঙ্গে ছিলেন।… গোলাম আজমসহ অনেকে এখনো মনে করেন না যে আমরা ভুল করেছি।’ সে আরো জানায়, ‘বিস্তারিত তদন্তের পর বেরিয়ে এসেছে, (বাংলাদেশের) স্থানীয় পিস কমিটির (রাজাকার গ্রুপ) লোকেরা নিজেদের স্বার্থে আমাদের সৈনিকদের দিয়ে এসব করিয়ে ফায়দা লুটেছে। আমরা বিদেশি, সেখানে (বাংলাদেশে) কাউকে চিনতাম না। আপনাদের ওই লোকদের (রাজাকারদের) জিম্মাদারে আমাদের সেনারা অপারেশন চালিয়েছে, ফলে বহু সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছে।’
এরপর কথাপ্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা উল্লেখ করে টিক্কা খান বলে যে, ‘যে শেখ মুজিব সাহেব তোমাদের ক্রীতদাসত্ব থেকে, গোলামি থেকে আজাদ করে দিয়েছেন এবং স্বাধীন জাতির মনজিল-এ-মকসুদের সিংহাসনে তোমাদের আসীন করে দিয়েছেন; তাকে তোমরা কী করে খুন করে ফেললে? এই পাপের জন্য দুনিয়ার সব মানুষ তোমাদের কী বলে ডাকবে জানো? বেঈমান, বেঈমান নামে ডাকবে। তোমরা তার সঙ্গে গাদ্দারি করে তাকে খুন করেছো। উনার (বঙ্গবন্ধুর) সঙ্গে রাজনৈতিক বিবাদ যা কিছু ছিল, তা ছিল আমাদের সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। আপনাদের জন্য শেখ মুজিব সাহেব ছিলেন, আমাদের কাছে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমকক্ষ ও সমতূল্য নেতা। আপনারা উনাকে খুন করলেন!’
কথার শেষ পর্যায়ে কসাই টিক্কা খান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।। বিদায়ী কথা হিসেবে সে বলে, ‘শেখ মুজিবের মতো মহামানব আমি আমার জীবনে আর দেখিনি। তিনি ছিলেন বিশাল পাহাড়ের মতো প্রশান্ত ও গুরুগম্ভীর। আপনি যেই হোন না কেন, তার সামনে আপনার ও সবার মাথা নত হয়ে আসবে। তার মতো বিশ্ব নেতাকে আপনারা স্পর্শ করেছেন কোন সাহসে? তার মৃত্যুর পর আফসোস করে বিশ্বের সব নেতাই বলেছেন যে, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের দেশের জন্ম হতো না।’
আরও পড়ুনঃ
কিভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল ডিক্টেটর জিয়া
আন্দোলনে আগ্রহ নেই বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের,সাড়া নেই জনগণেরও