বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার কালো রাজনীতির সূচনা করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
১৯৭৬ সালের ২৮শে জুলাই রাজনৈতিক দল বিধির আওতায় ‘নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক তৎপরতা’র সুযোগ দেওয়া হয়। শর্ত দেওয়া হয়, ঘরে বসে রাজনীতি করতে হবে, রাজপথে বা মাঠে যাওয়া যাবে না। অদ্ভুত এই রাজনীতির নাম দেওয়া হয় ‘ঘরোয়া রাজনীতি’।
এর মধ্য দিয়েই মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কবর দেন জিয়া। ৪ঠা আগস্ট ১৯৭৬ রাষ্ট্রপতি সায়েম রাজনৈতিক দল গঠনের নীতিমালা (পিপিআর) ঘোষণা করে। কিন্তু শাসকচক্র আওয়ামী লীগের সামনে অসম্ভব এমন এক শর্তের প্রাচীর তুলে দেওয়া হয়।
যেখানে বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি ভক্তি বা বিশ্বাস গড়ে তুলতে পারে এমন কোনো নাম দল গঠনের প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্রে উল্লেখ থাকতে পারবে না।’
এমন শর্ত জুড়ে দেওয়া ছিল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিনষ্টের ষড়যন্ত্র। নানা শর্তের শৃঙ্খলে বন্দী রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই ৯ই আগস্ট থেকে নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয় এবং ৯ই অক্টোবর ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়।
একদিকে ভোটার তালিকা প্রণয়ন-প্রকাশ, ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি অন্যদিকে সারাদেশে সামরিক আদালত প্রতিষ্ঠা করে তথাকথিত রাষ্ট্রবিরোধী এবং ধ্বংসাত্মক কাজের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতে থাকে।
১৪ই সেপ্টেম্বর ২৭টি মহকুমায় সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত গঠন করা হতে থাকে। ৪ঠা নভেম্বর তুমুল বিতর্কের মধ্যেই হৃদয়ে এক সাগর রক্তক্ষরণ বহন করেই বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ না করে অনুমোদন নিতে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ। গণমানুষের জন্য রাজনীতি করে দেশ স্বাধীন করা দলটিকে দিতে হয়েছিল এমন অগ্নিপরীক্ষা।
১৯৭৬ সালের ২১শে নভেম্বর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এএসএম সায়েম এক ঘোষণার মাধ্যমে পূর্ব প্রতিশ্রুত ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭-এর নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য হন। অথচ ১৯৭৫ সালের ২রা ডিসেম্বর সায়েম ঘোষণা করেন ‘দেশে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই বর্তমান সরকারের প্রধান লক্ষ্য।’
১৫ই ডিসেম্বর তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। ১৯৭৬ সালের ২২শে মার্চ নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণের খসড়াও তৈরি হয়।
১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর সেনাপ্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন।
প্রকৃতপক্ষে, নির্মোহ চিত্তে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে কেবল জিয়াউর রহমানের আমলকে জোরপূর্বক পদ দখল আর বন্দুকের নলের খোঁচায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্টের অধ্যাদেশ, আদেশ ও আইন জারির সময়কাল বা ষড়যন্ত্রের অমানিশা বলা যেতে পারে।
জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেই এক সামরিক ফরমান জারি করে তিনি নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক তো ঘোষণা করেছিলেনই, আবার নিজেই আরেক ফরমান জারি করে ঘোষণা দেন তিনি দেশের ‘প্রেসিডেন্ট’ও।
কে তাকে প্রস্তাব দিল, কে তাকে ভোট দিল! কোনো ঘটনারই প্রয়োজন পড়ল না, শুধু সামরিক ফরমান জারি করার মাধ্যমে জাতিকে জানিয়ে দেওয়া হয়- ‘এখন থেকে তিনিই দেশের প্রেসিডেন্ট।