সম্প্রতি দুবাই সরকার সেখানে থাকা দীর্ঘদিন দেখভাল না করা সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনে মনোনিবেশ করেছেন। এ বিষয়ে তদন্ত চালালে জানা যায়, দুবাই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার অন্তত ১০০ বিঘা জমি রয়েছে। যার বর্তমান মূল্য ১৩২ মিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০০৩ সালে জমি কেনার পর উক্ত জমিগুলোর কোনো খবর নেয়া হয়নি। আর এ কারণে সকল সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে দখল নিতে চাইছে দুবাই সরকার। এ প্রসঙ্গে দুবাইয়ের যুবরাজ হামদান বিন মোহাম্মাদ আল মাখতুম বলেন, আমরা এমন ৯৫৬ বিঘা জমি পেয়েছি। যার খোঁজ বিগত ১৫ বছর ধরে কেউ নিচ্ছে না। আর এ কারণে আমরা সেসব সম্পত্তিকে বাজেয়াপ্ত করছি।
তিনি আরও বলেন, যে বা যারা এসব জমি ক্রয় করেছেন, তাদের হয়তো এসব জমির প্রয়োজন নেই। যদি প্রয়োজন থাকত, তবে নিশ্চয় তারা জমিটি এভাবে ফেলে রাখতো না। উপযুক্ত জমির অভাবে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ আটকে আছে আমাদের।
উল্লেখ্য, সম্পদের হিসাব না নেয়ার তালিকায় বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং আফগানিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আশরাফ গানির নাম রয়েছে। খালেদা জিয়াকে অভিযুক্ত করে ইতিমধ্যে এক রাজকীয় ফরমানও জারি করেছে দুবাই কর্তৃপক্ষ।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সম্পদ বিদেশ পাচার এবং ব্যক্তিগত কাজে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে খালেদা জিয়া ও আশরাফ গানির বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে দুবাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, পাকিস্থান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী- নওয়াজ শরিফ, আশরাফ গানি এবং খালেদা জিয়া অবৈধ অর্থের মাধ্যমে দুবাইয়ে বিভিন্ন সম্পত্তি ক্রয় করেছেন। এ ব্যাপারে অধিকতর তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও কামনা করেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, দুবাইসহ খালেদা জিয়ার পরিবার বিভিন্ন দেশে কয়েক হাজার কোটি ডলারের সম্পত্তি ক্রয় করেছেন। যার মধ্যে বুর্জ খলিফায় বে ভিলা অ্যাপার্টমেন্টসহ কয়েকটি বহুতল ভবনও রয়েছে। দুবাইয়ের জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কমিশন জানিয়েছে, এ ব্যাপারে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তবে বিস্তারিত কিছু জানাতে অস্বীকার করেছে কমিশন।
তাদের ভাষ্য, তদন্ত চলমান থাকায় বিস্তারিত তথ্য জানানো যাবে না। এতে তদন্ত কাজ ব্যাহত হতে পারে। তদন্ত শেষে আইন অনুসারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানানো হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে। বিভিন্ন দেশে জিয়া পরিবারের সম্পদের অতি সামান্য অংশের হদিস মিলেছে:
খালেদা জিয়ার স্বামী স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দেখানো হয়েছিল, একটি ভাঙা স্যুটকেস ছাড়া তাদের কিছুই নেই। কিন্ত বাস্তবে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান মৃত্যুর সময়ও বিপুল সম্পদ রেখে যান।
সাভারে এবং দিনাজপুরে জিয়াউর রহমানের ৩২ বিঘা জমির সন্ধান পাওয়া যায়, যা খালেদা জিয়া এখনও বিক্রি করেননি। এই জমিগুলোর মালিক খালেদা জিয়া। এছাড়াও জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর খালেদা জিয়াকে দুটি বাড়ি দেয়া হয়েছিল।
ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটির লিজ চুক্তি বাতিল করা হয় আর গুলশানের বাড়িটিতে এখন একটি বহুজাতিক কোম্পানিকে খালেদা জিয়া ভাড়া দিয়েছেন। সেই বাড়িটিও খালেদা জিয়ার নামে। খালেদা জিয়ার কিছু হলে এই বাড়িটির মালিক কি সরকার পাবে নাকি তার পরিবারের সদস্যরা পাবে এ নিয়ে আইনগত বিতর্ক রয়েছে। এছাড়াও খালেদা জিয়ার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ২০ কোটি টাকার কাছাকাছি রয়েছে, যেটি তিনি ২০০৭ সালে জরিমানা দিয়ে বৈধ করেছিলেন।
এ তো গেলো দেশে তার বৈধ সম্পত্তির হিসেব। কিন্তু বিভিন্ন দেশে খালেদা জিয়ার বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে যার মাত্র অল্প কিছুর হদিস রয়েছে। অগোচরে এবং বেনামে থাকা সম্পত্তির পরিমাণ অকল্পনীয়।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, খালেদা জিয়ার সম্পদের কিছু অংশ দেখভাল করেন মোসাদ্দেক আলি ফালু। তিনিই খালেদা জিয়ার আর্থিক বিষয়াদি দেখাশোনা করেন। এখন যদিও মোসাদ্দেক আলি ফালু সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। কিন্তু সেখান থেকে তিনি সব ব্যবসা পরিচালনা করেন।
সূত্র সূত্র বলছে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার এবং মালয়েশিয়ায় খালেদা জিয়ার বিপুল সম্পদ রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে রয়েছে অত্যন্ত মূল্যবান রত্ন-পাথর, সোনার গহনা ও অ্যান্টিক সামগ্রী। এসব সম্পদের বিবরণ সৌদি আরবের একটি পত্রিকায় বেশ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে সে তথ্য অস্বীকার করা হয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অবসরপ্রাপ্ত একজন সামরিক কর্মকর্তা- যিনি বিএনপি আমলে অবসরে যান, তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সম্পদ কোনোটাই তার নিজের নামে নেই। সেসব গচ্ছিত রাখা হয়েছে বেনামে। তিনি জানতেন ক্ষমতার পালা বদল হলে এসবের তত্ত্ব-তালাশ হবে। তাই তিনি বিদেশি বিভিন্ন প্রাইভেট ফার্মের মাধ্যমে এসব সম্পদ জমা রেখেছেন।
এসব কারণেই তার সম্পত্তির সঠিক হিসেব কখনই বের করা সম্ভব নয়। একমাত্র খালেদা জিয়া ও তার আস্থাভাজন মোসাদ্দেক আলী ফালু ছাড়া কেউই এসব সম্পত্তির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ জানে না।
তবে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেসব সম্পত্তি, বিনিয়োগ ও সম্পদ জমা রয়েছে, সেসবের আর্থিক মূল্য বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
সৌদি আরবে খালেদা জিয়ার একটি শপিং মল, অন্তত ১৪টি বিলাসবহুল পেন্টহাউজ অ্যাপার্টমেন্ট, ৬টি বাড়ি এবং একাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সৌদি আরবের কয়েকটি বেসরকারি ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানি কর্তৃক এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয়। সেখানে এমনকি বিএনপির সৌদি আরব শাখার কাউকেই চাকরিতে রাখা হয়নি। সেখানে তার বিনিয়োগ আছে সরকারি কয়েকটি খাতেও।
এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে খালেদা জিয়ার অন্তত ৫টি সুপারশপ, ২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বেশ কিছু স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে বলে জানা গেছে। খালেদা জিয়ার কুয়েতে দুটি ব্যবসার খবর জানা গেছে। মালয়েশিয়াতেও বেনামে তার বিপুল সম্পদ রয়েছে। পর্যটন খাত এবং ‘সেকেন্ড হোম’ প্রজেক্টে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে কোনো অপরাধী বা মুদ্রা পাচারকারী মালয়েশিয়ায় স্থায়ী হতে চাইলে ‘সেকেন্ড হোম’ প্রজেক্টের অধীনে অনেক বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সুযোগ পান। আর এখানে খালেদা জিয়ার প্রতিষ্ঠান পুরো বিষয়টি দেখভাল করে।
খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন এবং এরপর মোসাদ্দেক আলী ফালু তার একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় খালেদা জিয়া যে সমস্ত অবৈধ উপার্জন করতেন তা বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতো এবং সেই অর্থ বিনিয়োগ করতেন মোসাদ্দেক আলী ফালু নিজে।
মোসাদ্দেক আলী ফালুর সঙ্গে সৌদি আরবের প্রশাসনের শুরু থেকেই ভালো সম্পর্ক ছিল। যা কাজে লাগিয়ে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় তিনি অর্থ বিনিয়োগ করেন, যেখান থেকে নিয়মিত লভ্যাংশ পান। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে মোসাদ্দেক আলী ফালু রীতিমত পাল্লা দিয়ে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে একযোগে দুর্নীতি শুরু করেন। আর এই দুর্নীতির অংশ হিসেবেই জিয়ার নির্দেশে বিপুল সম্পদ ফালুর কাছে যায়।
২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়েই আসলে খালেদা জিয়ার বিপুল বিত্তের বিকাশ ঘটে। এই সময় খালেদা জিয়া তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে ফালুর ব্যাবসায়ীক পার্টনার করেন। দেখা যায়, ফালুর যত ব্যবসা রয়েছে প্রায় সবগুলোতেই আরাফাত রহমান কোকো পার্টনার ছিলেন।
এসব সম্পদের মালিক কে হবে এই নিয়ে খালেদা জিয়ার পরিবারের মাঝে টানাপোড়েন চলছে। যদিও খালেদা এখন পর্যন্ত কোন আনুষ্ঠানিক উইল করেননি। আইন অনুযায়ী তার কিছু হলে বৈধ উত্তরাধিকার তারেক রহমান। কিন্তু পরিবারের একটি সূত্রের দাবি, খালেদা জিয়া তার পুত্র তারেক রহমানকে নিজের নামে থাকা সম্পদের ভাগ দিতে চান না। বরং তিনি তার প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর দুই সন্তানের কাছেই বড় অংশ দিয়ে যেতে চান। খালেদা তার সম্পদের কেয়ারটেকার ফালুকেও এই ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন বলে শোনা যয়।
মোসাদ্দেক আলি ফালুর সাথে তারেক রহমানের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। আর এ কারণেই তারেক বা তার পরিবারের কোন সদস্য খালেদা জিয়ার কঠিন সময়ে তার পাশে আসছেন না বলে দাবি দলের নেতাদের। যেহেতু খালেদার অধিকাংশ সম্পদ বেনামে তাই এসব মৌখিক নির্দেশেই উত্তরাধিকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ঢাকায় যে বৈধ সম্পত্তি রয়েছে তা মুসলিম আইন অনুযায়ী বন্টন করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানা গিয়েছে। তাহলে সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ভাই এবং বোন কী পাবে তা নিয়ে তাদের মধ্যেও এক ধরণের উৎকণ্ঠা রয়েছে।