রাতের অন্ধকারে, কয়েক হাজার সেনাসদস্যকে বিনাবিচারে হত্যার পর, একদিন নিজেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ৩০ মে, চট্টগ্রামের বিক্ষুব্ধ সৈনিকদের ব্রাশফায়ারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জিয়া ও তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীরা। ব্রাশফায়ারে উড়ে যায় তাদের মুখ-বুকসহ ও শরীরের ওপরের অর্ধেকাংশ। ক্ষুব্ধ আততায়ীরা সেগুলোকেও জ্বালিয়ে দেয় গান পাউডারে। তাই পরের দিন সার্কিট হাউসে পড়ে ছিল শুধু পুড়ে যাওয়া রক্ত ও মাংসের কিছু কালো দলা। আলাদা করে জিয়াউর রহমানকে চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল না। আর সেখানে উপস্থিত কেউ জিয়ার লাশ নিজের চোখে দেখেনি কখনো।
তবে সেই সার্কিট হাউসে পড়ে থাকা লাশগুলো পরবর্তীতে রাঙুনিয়ার এক পাহাড়ের পাদদেশে মাটি চাপা দেওয়া হয়। স্থানীয় কবির আহমেদ নামের যে ব্যক্তি সেই গণকবর খুঁড়েছিলেন, তিনিও কোনো লাশ দেখেননি। শান্তিবাহিনীর হাতে নিহত সেনাদের লাশ দাফন করার কথা বলা হয়েছিল তাকে।
পরেরদিন, ১ জুন। সেই গণকবর থেকে একটি গলিত লাশ তুলে কাঠের বাক্সে ভরা হয়। সেসময় তাকে বলা হয়- এটি জিয়াউর রহমানের লাশ। কিন্তু রাঙ্গুনিয়ার স্থানীয় কোনো ব্যক্তিকেও সেই লাশ দেখানো হয়নি।
এরপর, সামরিক পোশাক পরা একটি গলিত-খন্ডিত দেহকে জিয়াউর রহমানের লাশ বলে কাঠের বাক্সে করে ঢাকায় আনা হয়। বাক্সের মুখ খুলে, ঢাকাতেও কাউকে দেখানো হয়নি সেই লাশ। বাক্সসহ জিয়ার লাশ বলে সেই লাশের জানাজা এবং কবর দেওয়া হয়।
কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত হলে, এটি নিয়ে সন্দেহ শুরু হয়। প্রথমত- ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম মেনে পরিবার, স্বজন বা সরকারের কাউকে দিয়ে শনাক্ত করানো হয়নি সেই লাশ। দ্বিতীয়ত- রাঙ্গুনিয়ার কবর থেকে তুলে আনা লাশটিকে সৈনিকরা শনাক্ত করতে না পারলেও, তার পরনে যে সামরিক পোশাক ছিল সেটি তারা নিশ্চিত করেছে। আর এই সামরিক পোশাককে কেন্দ্র করেই ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে।
কারণ, জিয়াউর রহমান তখন সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছেড়ে পুরোদমে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। চলতেন সিভিল পোশাকে। আর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মধ্যরাত পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও সাধারণ পোশাক পরেই বৈঠক করেছেন তিনি। ঘুমাতে গিয়েছিলেন নাইট ড্রেস পরে। সামরিক পোশাকের সঙ্গে তখন তার কোনো সম্পৃক্ততাই ছিল না।
বাস্তবতা হলো, আশির দশকের শুরু থেকেই ‘কাঠের বাক্সে লাশের রহস্য’ নিয়ে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়। এমনকি অনেকে এটি নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্নও তুলেছিলেন। কিন্তু সবসময় বিষয়টি পাশকাটিয়ে গেছে বিএনপি।
এমনকি মার্কিন গোয়েন্দাদের একটি গোপন দলিল প্রকাশ হওয়ার পর জানা যায়, হত্যার পর জিয়ার লাশ গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছিল। পরে সেই ছাই পাহাড়ের কোনো ঢালে ফেলে দেওয়া হয়। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরেও চুপ ছিল বিএনপি। এমনি কাঠের বাক্সের ভেতরে আসলে কার লাশ ছিল, তা নিয়ে কখনোই জীবদ্দশায় কখনোই মুখ খোলেননি বিএনপি নেতা বিগ্রেডিয়ার হান্নান শাহ। কিন্তু পুরো কাঠের বাক্স নাটকটির সঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত ছিলেন তিনি। অন্যদিকে বিএনপি থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও জিয়ার সেই কথিত কবরে ফুল যাননি বদরুদ্দোজা চৌধুরী। কারণ, তিনিও ব্রিগেডিয়ার হান্নানের মতো জানতেন যে- ওই কাঠের বাক্সে আসলে জিয়ার লাশ ছিল না। ওই লাশটি ছিল কোনো ভাগ্যহত সৈনিকের। বিএনপি নেতাদের লাশের রাজনীতির কারণে, ওই সেনাসদস্যের পরিবার হয়তো তার মৃত্যুর খবরটিও জানতে পারেনি!
তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে স্পষ্ট মন্তব্য করায়, এটি নিয়ে রাজনীতি করতে শুরু করেছে বিএনপি নেতারা। অথচ তারা যদি নিশ্চিত হতো- ওই বাক্সের ভেতর জিয়াউর রহমানের লাশ আছে; তাহলে তারা প্রকাশে ডিএনএ-টেস্ট করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতো। চন্দ্রিমা উদ্যানের কবরে থাকা অজ্ঞাত লাশটি আসলে কার? এটি যেমন কখনোই জানতে দিতে চায় না বিএনপি, তেমনি জিয়া হত্যার বিচারও কখনো চায়নি বিএনপি। এমনকি খালেদা জিয়া-তারেক রহমানও কখনো এই হত্যার বিচার নিয়ে কথা বলেনি। তারা চায় এদেশের সরলপ্রাণ মানুষকে উগ্রতার পথে ধাবিত করে, দেশকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে। আর যদি সত্যই তারা জিয়াউর রহমানের লাশ খুঁজতে চায়, তাহলে তারেক রহমানের প্রতি আহ্বান- দেশে আসুন, ডিএনএ দিন, পিতার লাশের পরিচয় পরীক্ষা করান। কিন্তু তারা কখনোই সেই পথে হাঁটেনি। কারণ তারাও জানে যে, জিয়ার লাশ আসলে চন্দ্রিমা উদ্যানে নেই।