ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আবেগকে পুঁজি করে ডাকসু নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন নুরুল হক নুর। কিন্তু এরপর থেকেই ভোল বদলে গেছে তার। সীমাহীন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস, দ্রুত ক্ষমতাবান হওয়া মোহ, অর্থ-বিত্তের লোভ- প্রভৃতি কারণে তিনি এখন ধর্মব্যবসায়ী ও উগ্রবাদীদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। এর আগেও, ডাকসুর ভিপি হওয়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশ কাটিয়ে শুধু নিজের কয়েকজন কর্মীকে নিয়ে ডাকসু ভবনে বসতেন তিনি। সম্প্রতি ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানিত্বের বিষয়ে নুরের ফতোয়া দেওয়ার ঘটনায় বিস্ময় ও লজ্জা প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
গত ১৪ এপ্রিল, ফেসবুক লাইভে দেওয়া ভিডিও বক্তব্য নুর বলেন, ‘কোনো মুসলমান আওয়ামী লীগ করতে পারে না, যারা আওয়ামী লীগ করে তারা চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, চিটার, বাটপার। প্রকৃত কোনো মুসলমান আওয়ামী লীগ করতে পারে না। এদের কোনো ঈমান নাই। শুক্রবার একদিন নামাজ পড়তে যাবে, আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কোনো খবর নাই।’
নুরের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলভী খান বলেন, ‘বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য নুর মরিয়া হয়ে গেছে। খেয়াল করে দেখবেন- সে মাঝে মাঝে মানুষের অধিকারের কথা বলে। কিন্তু হেফাজত-জামায়াতের রগকাটা রাজনীতি, কওমি মাদ্রাসার বলাৎকার, শিশু নির্যাতন, এসব নিয়ে কিন্তু কখনো মুখ খোলে না। ডাকসুর ভিপি নির্বাচনের সময় তাকে ভোট দেওয়ার জন্য আমি লজ্জিত।’
আরেক শিক্ষার্থী নয়ন আহমেদ বলেন, ‘ফেসবুক লাইভে এসে মিথ্যা নাটক করে, মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে, দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে নুর। যেহেতু সে ডাকসু ভিপি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তার একটা পরিচিতি আছে। তার বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যে মফস্বল এলাকার তরুণরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে মৌলবাদের উত্থানে তার এই ভূমিকা খুব ন্যাক্কারজনক। কোটা আন্দোলনের সময়ও এবি সিদ্দিকী মারা গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল নুর। এখন সে ধর্ম নিয়ে খেলছে। একবিংশ শতাব্দির একজন ডাকসু নেতা ফতোয়া দিচ্ছে, ধর্মান্ধ-উগ্রবাদীদের পক্ষে কথা বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা একটা কলংকিত অধ্যায়। নুরের এসব কর্মকাণ্ডের জন্য ডাকসু নিয়েও এখন লোকজন হাসাহাসি করে।’
নুরের উত্থান সম্পর্কের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামিম মুনতাসির বলেছেন, ‘ক্যাম্পাসে তখন কোনো সক্রিয় বিরোধীদল ছিল না। দীর্ঘদিন ধরেই কোটা সংস্কারের আন্দোলন চলছিল। তখন নুরও সেই আন্দোলনে যোগ দেন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ভুলের কারণে নুর দ্রুতই কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফোকাসে চলে আসেন। মূলত সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের হাতে মার খাওয়ার পর, সেটা নিয়ে ফেসবুকে আবেগঘন লাইভ করে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন নুর। যার ফলে তার প্রতি সবার মনে সিমপ্যাথি সৃষ্টি হয়। এরমধ্যেই ডাকসু নির্বাচন হলো। শিক্ষার্থীদের সিমপ্যাথির ভোটে জিতে গেলো নুর।’
রেদওয়ান খন্দকার নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা মুক্তপ্রাঙ্গণ। এখানে কট্টরপন্থী, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, এদের কোনো স্থান নাই। এখানকার অন্তত ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের। নিরাপদ সমাজের স্বপ্ন দেখে সবাই। একারণে একটা প্রতিবাদী সেন্টিমেন্ট কাজ করে এখানকার শিক্ষার্থীদের মনে। ভিপি নির্বাচনের সময় ঠিক এই আবেগটাকেই কাজে লাগিয়েছিল নুর। কিন্তু এখন তার যে জঙ্গিবাদী রূপ প্রকাশ হয়ে পড়ছে; এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ও মধ্যবিত্তের চেতনার পরিপন্থী। আমরা যারা নুরকে ভোট দিয়েছিলাম, তার মৌলবাদী তৎপরতার কারণে সবাই এখন অনুতপ্ত।’
নুরের বিষয়ে লজ্জা প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থীও। তারা বলেন, ”নিজের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ফেসবুকে লাইভ করে মানুষের সিমপ্যাথি আদায়ের চেষ্টা করেন নুর। এটা তার পুরাতন টেকনিক। ফেসবুকের লাইভ করতে গিয়ে গুজবও ছড়িয়েছেন তিনি বেশ কয়েকবার। এমনকি ভিপি থাকার সময় বনানীর বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শুধু সেলফি তুলতেই সেখানে গিয়েছিলেন নুর। ভবনে যখন অগ্নিদগ্ধ মানুষের আহাজারি চলছিল, সবাই উদ্ধার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তখনও হাসিমুখে সেই অগ্নিকাণ্ডের সেলফি তুলে সমালোচনার শিকার হন নুর। তবে সম্প্রতি ধর্মব্যবসায়ী ও উগ্রবাদীদের মুখপাত্র হয়ে যেভাবে সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন তিনি, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা শিক্ষার্থীর লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে বিকশিত করার জায়গা, সেই প্রতিষ্ঠানের ভিপি হিসেবে নুরের কর্মকাণ্ড ‘বিলো দ্যা স্টান্ডার্ড’। ডাকসু ভিপি পদটাকে কলঙ্কিত করেছেন নুর।”
নুরের প্রতি মোহভঙ্গের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আরো জানান, যেহেতু সবার একটা সিমপ্যাথি ছিল নুরের প্রতি, তাই সবার ধারণা ছিল- গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে নুর হয়তো শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র হবেন। কিন্তু ভিপি হওয়ার পরেই নুরের আসল চেহারা বের হয়ে যায়। তিনি নিজের রাজনৈতিক দল সৃষ্টির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরপর তিনি নিজের প্রয়োজন ছাড়া আর কখনো সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। যখন নিজের স্বার্থের জন্য লোকজন দরকার হতো, তখন ফেসবুক লাইভ করে কখনো সিমপ্যাথি বা কখনো উস্কানি দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের জন্য ডাকতেন। এমনকি বিকাশ-রকেট ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নিয়মিত গণচাঁদা চান তিনি। আন্দোলনের কথা বলে প্রবাসীদের কাছ থেকেও ফরেন কারেন্সি নিতেন নুর।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভোটে নুরকে ভিপি নির্বাচিত করার পর, এখন তারাই নুরের ভিপি পরিচয় নিয়ে বিব্রতবোধ করছেন। নুরের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড একজন ডাকসু নেতার স্টান্ডার্ড এবং বাংলাদেশের আদর্শের সঙ্গে পুরোপুরি বেমানান বলেও মন্তব্য করেছেন শিক্ষার্থীরা।
নুরকে ভোট দিয়েছেন এমন একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, ‘দেশজুড়ে যখন হেফাজত ও জামায়াত-শিবিরের দুর্বত্তরা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়, নুর তখন তাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন, এটা খুব দুঃখজনক ব্যাপার। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দিচ্ছে হেফাজতের ধর্মব্যবসায়ীরা, অথচ নুর তাদের মুখপাত্র হিসেবে ভোটব্যাংক গোছানোর পাঁয়তারা করছে। এভাবে কয়টা ভোট পাবে নুর? নুর মধ্যবিত্তের আবেগের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তিনি এখন ফতোয়াবাজ, জঙ্গিবাদী ও ধর্মব্যবসায়ীদের দলে ভিড়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ধর্মব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারেনি। এদের মুখোশ আপনাআপনি খুলে যায়।’
প্রসঙ্গত, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১০দিন ধরে উৎসবের আয়োজন করা হয়। এসময় প্রতিবেশী দেশের সরকার প্রধানরা বাংলাদেশ সফরে আসেন। বিশ্বনেতারা অনলাইনে ভিডিও ও লিখিত বার্তা পাঠান। কিন্তু এই উদযাপন পণ্ড করার লক্ষ্যে ২৫ মার্চ বিক্ষোভের ডাক দেয় নুরের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদ। তাদের ডাকা কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয় বিএনপি-জামায়াত জোটভুক্ত দল জমিয়তের যুব নেতা এবং বিতর্কিত ‘শিশুবক্তা’ রফিকুল ইসলাম মাদানী। এরপর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা। যার জের ধরে ২৬ মার্চ মহান বিজয় দিবসের ঢাকা শহরে সহিংসতা ছড়ানোর চেষ্টা করে হেফাজতে ইসলাম। জুমার নামাজের পর মোনাজাত শেষ হওয়ার আগেই বায়তুল মোকাররম মসজিদে হাঙ্গামা শুরু করে তারা। সাধারণ মুসল্লিদের উস্কি দিয়ে নাশকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এই ধর্মব্যবসায়ীরা। কিন্তু দেশে অনেক বিদেশি রাষ্ট্রের অতিথি থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর তিন দিনব্যাপী চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের মাঠে নামিয়ে নাশকতা চালায় তারা। এসময় তাদের এসব কাজে উৎসাহ দিয়ে ফেসবুকে লাইভ করেন সাবেক ভিপি নুর এবং রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী।
পরবর্তীতে হেফাজতের দুর্বৃত্তায়ন থামাতে শক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নাশকতায় জড়িত হেফাজতের উগ্রবাদীদের ধরতে পুলিশ অভিযান শুরু করলে আবারো সক্রিয় হন নুর। সহিংসতা উস্কে দিয়ে বেশ কয়েকজন কর্মীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ট ও হেফাজত নেতা মামুনুল হক। সেই পরিবারগুলোতে যখন শোকের মাতম চলছিল, ঠিক সেই সময় নারীসঙ্গ উপভোগ করতে মামুনুল হক চলে যান নারায়ণগঞ্জের একটি বিলাসবহুল রিসোর্টে। সেখানে স্থানীয়রা তাকে আটক করে। পরে তথ্য-প্রমাণসহ প্রকাশ্য হয়ে পড়ে ভণ্ডপীর ও রাজাকারপুত্র মামুনুল হকের একাধিক নারী কেলেংকারীর ঘটনা। কিন্তু নুর এই বিষয়টিকেও ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন ফেসবুক লাইভ করে। তিনি পুরো বিষয়টি সরকারের ষড়যন্ত্র বলে গুজব ছড়ান। কিন্তু বেশ কয়েকদিন পর মামুনুল হক নিজে লাইভে এসে ইনিয়ে বিনিয়ে দায় স্বীকার করলে দেশবাসীর কাছে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে পড়ে। ফলে নুরের কথার গুরুত্ব হারিয়ে যায়, গুজব ছড়ানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু এরপর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন নুর। ১৪ এপ্রিল তিনি ফেসবুক লাইভে ঘোষণা দেন- ‘কোনো প্রকৃত মুসলমান আওয়ামী লীগ করতে পারে না।’ এর আগে, হেফাজত নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ফতোয়া দিয়ে বলেছিল- ‘আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ সবাই কাফের।’ ঠিক একই পথ ধরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে ধর্মবিদ্বেষী মন্তব্য করেন নুর।
এ বিষয়ে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া জান্নাত বলেন, ‘ডাকসু নেতা মানে কিন্তু একটা ওয়েট ছিল, সেটা যে দলেরই হোক। মানুষ কিন্তু সেই হিসেব করেই নুরকে গুরুত্ব দিতো। কিন্তু নুর এই জায়গাটাকে নষ্ট করে ফেলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডাকসু, ডাকসুর ভিপি, এই জায়গাগুলাতেই হাস্যকর বানিয়ে ফেলেছে সে। তার যে কাজকর্ম, তা কোনো বিবেকবান মানুষ করতে পারে কিনা জানি না! নুরু যে ধর্মের ট্রাম্পকার্ড খেলতে চাচ্ছে, এসব পাকিস্তান আমল থেকে চলছে। সাধারণ মানুষ এসব ফাটকাবাজি বোঝে। জাস্ট কারো কারো বুঝতে একটু বেশি সময় লাগে, এই আর কী। খেয়াল করে দেখবেন, নুরের গ্রহণযোগ্যতা কিন্তু আগের মতো নাই। যেভাবে হুট করে তাকে লোকজন মাথায় তুলেছিল, সেভাবেই তাকে ছুড়ে ফেলে দেবে। সাধারণ মানুষ বোকা না রে ভাই।’