বিশ্বব্যাপী নীতিবাগিশ হিসেবে নিজেদের জাহির করে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো। এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোর প্রতিটি অভ্যন্তরীণ বিষয়েও নাক গলায় তারা। অথচ, নিজেদের বেলায় নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই তাদের। কিন্তু কোনো দেশের সরকার যদি তাদের কথামতো না চলে, তাহলে সেই দেশের সরকার বদলানোর মিশনে নামে তারা। তখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার অজুহাতে কিছু জনপ্রিয় বুলি ছড়িয়ে সেই দেশকে বিশ্বব্যাপী নাজেহাল করতে শুরু করে পশ্চিমা বিশ্বের মোড়লেরা। অথচ, যেসব দেশ তাদের স্বার্থ রক্ষা করে, তাদের বেলায় পশ্চিমাদের অবস্থান ঠিক উল্টো। এদের এই দ্বিচারিতার শিকার বাংলাদেশও।
সম্প্রতি ব্রিটেনের নাগরিক শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব বাতিলের ঘটনাতেও তাদের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও এটা তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বাংলাদেশের সঙ্গে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। তারপরও তারা বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা করেছে এর সঙ্গে, এটি স্পষ্টই আমাদের সঙ্গে পশ্চিমাদের বর্ণবাদী আচরণ।
মূল ঘটনাটা হলো, ২০১৫ সালে শামীমা বেগম ১৫ বছর বয়সে নিজ দেশ ব্রিটেন থেকে পালিয়ে সিরিয়ায় যায় এবং আইএস-এ যোগ দেয়। পরে সে তার ভুল বুঝতে পারে এবং নিজ দেশে ফিরতে আর্জি জানায়। কিন্তু তার নাগরিকত্ব বাতিল করে ব্রিটেন। ব্রিটেনের আইনে বলা আছে, জনস্বার্থে কারো নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে, কিন্তু কাউকে রাষ্ট্রহীন করে তা করা যাবে না। তার মানে, তার জন্য অন্য কোনো দেশে আশ্রয় থাকতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্র ব্রিটেন নিজেরাই তাদের এই নিয়ম মানেনি। তারা রুল জানি করে জানায়- শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব বাতিল আইনসম্মত, কারণ তার মায়ের জন্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, শামীমার জন্ম ব্রিটেনে এবং সে সেখানেই বেড়ে উঠেছে। সে কখনো এদেশে আসেনি। এমনকি এদেশের নাগরিকত্বও চায়নি সে কখনো। সুতরাং তার মায়ের জন্ম বাংলাদেশে হলেও, শামীমার সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই ব্রিটেনের আইনজীবীদের মনগড়া ব্যাখ্যার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালে এক বিবৃতিজানায়, শামীমা বেগম যুক্তরাজ্যের নাগরিক অথচ তাকে বাংলাদেশী হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, এটা গভীর উদ্বেগের কারণ। পশ্চিমারা কীভাবে পদে পদে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলতে চায়, তার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত এটি।
বাংলাদেশকে নিয়ে পশ্চিমাদের সমস্যাটা আসলে অনেক পুরনো। একসময় এই বাংলার সম্পদ লুট করে, সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করেছিল তারা। সেই বাংলাদেশ আবারও বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এটা তাদের সহ্য হচ্ছে না। বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং সার্বভৌমত্বের বিষয়ে পশ্চিমাদের মনে এক ধরনের ‘সুপিরিয়রিটি কমাপ্লেক্স’ কাজ করে। তারা একসময় শাসন-শোষণ করেছে এই অঞ্চল, সেকারণে তারা এখনো আমাদের তাদের অধঃস্তন জাতি হিসেবে গণ্য করার চেষ্টা করে। তাদের মধ্য ‘হোয়াইট সুপ্রিমিসি’ কাজ করে, তারা মনে করে সাদা চামড়ার কারণেই তারা শ্রেষ্ঠ, অন্যকারো শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসার অধিকার নাই। আমাদের ব্যাপারে তাদের মানসিকতাই হুকুমদারিত্বমূলক।
বাংলাদেশের সবকিছুতেই তাদের সমস্যা। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সেনা কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ধর্ষণ ও গণহত্য নিয়েও পশ্চিমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এমনকি সাত লাখের বেশি মানুষকে রাখাইন থেকে তাড়ানোর পরেও মিয়ানমারের সর্বোচ্চ নেতা অং সান সুচিকে নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি পশ্চিমারা। উল্টো মানবিকতা দেখিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন সেই বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দিলেন, এরপর তারা বাংলাদেশের ভুল খুঁজতে এলো। এমনকি এখনো তারা ভুল খুঁজেই যাচ্ছে। এছাড়াও মিয়ানমারে বছরের পর বছর ধরে সেনাবাহিনী ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকলেও সেখানে কখনো গণতন্ত্র-মানবিকতার বুলি আওড়াতে দেখা যায়নি পশ্চিমাদের। অথচ, হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করার বিষয়েও পশ্চিমাদের হাজারো রকমের সমস্যা দেখা গেলো।
সৌদি আরবের রাজতন্ত্রের সঙ্গেও যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অতি মধুর। কম দামে আরবের তেল কিনতে পারে তারা, বেশি দামে বেচতে পারে অস্ত্র। বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। সেখানে মানবিকতা নিয়ে কথা বলাটাকে অনুচিত বলে মনে করে বর্ণবাদী পশ্চিমারা। ২০১৮ সালে, তুরস্কের দূতাবাসে একজন সৌদি সাংবাদিক খাসোগিকে বর্বরভাবে হত্যা করে লাশ পর্যন্ত গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) এই ঘটনার জন্য পরোক্ষভাবে দায় স্বীকার করেছে। তবে মার্কিন গোয়েন্দা নথির তথ্য থেকে জানা যায়, সৌদি যুবরাজই এই হত্যার নির্দেশনা দিয়েছে। অবশ্য পরবর্তীতে সৌদি যুবরাজকে রক্ষার জন্য সন্দেহভাজনদের তালিকা থেকে তার নাম পর্যন্ত সরিয়ে দিয়েছে তারা। সন্ত্রাসী কায়দায় তুরস্কে বিমান নিয়ে এসে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে, আবার বিমান নিয়ে সৌদি আরবে ফিরে গেছে খুনির দল। ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হওয়ার পর, পুরো বিশ্বের কাছে এই বিষয়টি স্পষ্ট। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের তাতে কিছু যায় আসে না, সৌদি আরবের সঙ্গে তাদের মধুর সম্পর্কের বিন্দুমাত্র তারতম্য হয়নি তাতে। এমনকি পেড্রো-ডলারের মোহে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পর্যন্ত সৌদিতে গিয়ে নেচেছেন একনায়কতান্ত্রিক সরকারের সদস্যদের সঙ্গে।
রাজতন্ত্রের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক, একনায়কদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, এসব পশ্চিমা গণতন্ত্রের নিত্যমিত্র। এমনকি তাদের মন খুশি করে দিয়ে, আপনি যদি খুনখারাপি-জবরদখল করেন, তাহলেও সেটা তাদের কাছে নমস্য। কিন্তু আপনি যদি নিজের দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন, তাহলেই মুখ বেজার হয় পশ্চিমাদের।
কয়েক শত বছর ধরে আফ্রিকা-এশিয়ার মানুষদের দাস বানিয়ে রেখেছিল তারা, এখনও খাই খাই স্বভাব শেষ হয় নাই। এশিয়ার রাজনীতিতে ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকায় বাংলাদেশের প্রতি তাদের নজর লেগে থাকে সবসময়। পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছে, যা বিশ্বের অন্যতম একটি বৃহত্তম সেতু; এদিকে খুব কম ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমেই করোনাভাইরাসের মতো সর্বগ্রাসী মহামারিও মোকাবিলা করতে সমর্থ্য হয়েছে সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে অভাব দূর করে উন্নত জীবনের পথে যাত্রা করেছে দেশের মানুষ। কথা হলো, ‘ভেতো বাঙালি’রা আজ বিশ্বব্যাপী মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে, পশ্চিমাদের সমান্তরালে পা ফেলে চলতে শুরু করেছে, এটি তাদের বিষম মর্মপীড়ার কারণ।