মেজর হাফিজউদ্দিন আহমেদ। বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ও জামাত-বিএনপি সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। দ্বীপ জেলা ভোলার লালমোহনের এই রাজনীতিবিদ একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাও। তরুণ বয়সে দারুণ ফুটবল খেলতেন। ফিফা তাকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশী ফুটবলারের স্বীকৃতিও দিয়েছিল। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এবং এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনেরও। এমন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের একজন মেজর হাফিজের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে চরম একজন সাম্প্রদায়িক মানুষ।
এবার আসি আসল কথায়। ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোলার লালমোহন থেকে সংসদ নির্বাচিত হোন মেজর হাফিজ। ওই নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট জিতলে দেশজুড়ে শুরু হয় নজীরবিহীন সংখ্যালঘু নির্যাতন। দেশের যেসব জায়গাতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মাত্রা ব্যাপকতা ছাড়িয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম দ্বীপ জেলা ভোলা।
২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে জেতার পর পরই মেজর হাফিজ এবং নাজিম উদ্দিন আলম নিয়ন্ত্রিত ভোলাতে চলে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের মহড়া। সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়িতে হামলা, লুটপাট, ভাংচুর, অগ্নি সংযোগসহ তাদের বাড়ীর কিশোরী মেয়েদের তুলে এনে ধর্ষণ ছিল তখনকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শুধু হিন্দুদের বাড়িই নয়, তখন যারা আাওয়ামী লীগ করতো বা সমর্থন করতো তাদের মাঠের ফসল, গোয়ালের গবাদী পশু দিনে দুপুরে নির্দ্বিধায় তুলে নিয়ে যাওয়া ছিল খবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
শুধু তাই নয়, ২০০১ এর নির্বাচনের পর ভোলার প্রায় কোন মন্দিরই আর অক্ষত ছিল না। প্রতিটি মন্দিরের প্রতিমা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। পরিস্থিতি এমন জটিল পর্যায়ে গিয়েছিল যে, নির্বাচনের পর চারদিন ধরে আওয়ামী লীগের কোন নেতা-কর্মী এবং সমর্থকরা বাড়ির বাইরে বের হতে পারেনি। ওই সময় অবরুদ্ধ থাকায় তিনদিন খাবার না পেয়ে শিশুরা পুকুরের কাঁচা মাছ চিবিয়ে খেয়েছে।
২০০১ সালের নির্বাচনের সময় ভোলার লালমোহনে একটি বেসরকারী সংস্থায় কাজ করা দিয়া আফরিনের বর্ণনাতেও উঠে এসেছে মেজর হাফিজের সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উপর ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র।
দিয়া অাফরিন তার বর্ণনাতে বলেন, নির্বাচনের পর দেখেছি শত শত নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। বাবাকে বেঁধে রেখে মেয়ে ও মাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। বাবা-মায়ের সামনে মেয়েবে ধর্ষণ করা হয়েছে। ভাইয়ের সামনে বোনকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেক সময় ধর্ষণ করার পর যৌনিপথে ব্যাটারি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এমন নারীর দেখাও মেলেছে তখন। সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকাতে ভোট দেয়ার অপরাধে অনেক সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেক নারীকে ধর্ষণ করার পর তাদের যৌনিপথে সেই সময় বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষ ঢুকিয়ে দেয়ারও নজির পাওয়া গেছে। বেশ কিছু নারীর যৌনিপথ চাকু দিয়ে কেটে রক্তাক্ত করে ধর্ষকরা পাশবিক উল্লাসে মেতেছে।
এখানেই নির্যাতনের শেষ নয়, ধর্ষণের পর কোন ধর্ষিত নারী যাতে ভোলার কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে না পারে তারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময়ের প্রভাবশালী মন্ত্রী মেজর হাফিজের পক্ষ থেকে।
ভোলার একটি হাসপাতালের হিন্দু মহিলা ডাক্তার বশে কয়েকজন ধর্ষিতা মেয়ের চিকিৎসা করেছিল বলে তাকে মেজর হাফিজের ক্যাডাররা ডেকে নিয়ে তাকেও ধর্ষণ করেছিল। এর মাধ্যমে ডাক্তারদেরও স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিল মেজর হাফিজের ক্যাডাররা যে, কোন ধর্ষিত নারীকে চিকিৎসা দিলে তার পরিণতি কি হতে পারে।
ভোলার চর ফ্যাশন যুবদলের সভাপতি ছিল দিপু ফরাজী। তার বাড়িকে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে কয়েক শত সংখ্যালঘু নারী আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু মধ্যরাতে বিএনপি-জামাতের ক্যাডাররা ওই বাড়িতে হামলা চালালে ছুটে পালাতে থাকে ওইসব নারীরা। সেই রাতে হারিয়ে যাওয়া অনেক নারীর আজও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেক নারী বাড়িরর পাশের পুকুরের শীতের রাতে পুরো শরীর ডুবিয়ে রেখেছিল শুধু ধর্ষণের হাত থেকে রেহায় পেতে।
ভোলার বোরহান উদ্দিন থানার বাংলা বাজারে এক হিন্দু বিবধা নারীর একমাত্র সম্বল ছিল একটি ষাড় গরু। মেজর হাফিজের ক্যাডাররা ওই মহিলার সামনে সেই ষাড়টাকে জবাই করে হিন্দু মহিলাকে কিছু গরুর মাংস দিয়ে বাকিটুকু নিয়ে গিয়েছিল।
২০০১ সালের পর যেকোন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ এখনো ভয়ে কুকড়ে উঠে মেজর হাফিজের ওই নির্মম নির্যাতনের কথা মনে করলে। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতা-কর্মীরা মন্ত্রী মেজর হাফিজের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে তখন তিনি নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতেন, আমার কাছে কিছু চাইতে আসার আগে তোদের চোখে কি পড়ে না আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও হিন্দুদের বাড়ির গরু-ছাগল। ওইগুলো বিক্রী করেও টাকাতে না হলে তার পর আমার কাছে আসবি। এইসব কথা সেই সময় খুব দম্ভ করে বলতো মেজর হাফিজ।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ভয়াবহতম, বর্বর ও নৃশংস সংখ্যালঘু নির্যাতনের পর দেশে-বিদেশে তীব্র সমালোচনা হলেও তখনকার সরকার এর কোন প্রতিকারই করেনি। পরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রেক্ষিতে গণতদন্ত কমিশন গঠিত হলে যেসব এলাকায় ব্যাপকহারে সংখ্যালঘু নির্যাতন করা হয়েছে এবং যাদের প্রত্যক্ষ মদদে করা হয়েছে সেই তালিকায় ভোলা জেলায় মেজর হাফিজের নেতৃত্বে হয়েছিল বলে তদন্ত কমিশনে উঠে এসেছে। ওই কমিশনের সুপারিশে মেজর হাফিজকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারণে অভিযুক্ত করা হয়েছে।