
গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রয়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফরজ্জামান বাবর। ফাঁসির আদেশ হওয়া বিএনপি সরকারের এক সময়ের প্রভাবশালী মন্ত্রীর এখন আগের মত আর দাপট না থাকলেও এলাকার কিছু মানুষ তার কাছে এখনো মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে। বিপুল পরিমাণের সম্পদের মালিক বাবরের কাছে এলাকার কিছু নেতা-কর্মীরা দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে টাকার জন্য আসেন।
১৯ আগস্ট বাবরের সাথে দেখা করতে যান তারই এলাকার তার কাছের এক প্রভাবশালী বিএনপি নেতা। বাবর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকা কালীন সময়ে নেত্রকোণা এলাকায় ওই নেতার দাপটে তখন মানুষ তটস্থ থাকতো। এখন আগের মত সেই দিনও নেই এলাকায় তার সেই প্রতিপত্তিও নেই। কাশীমপুর কারাগারে যেয়ে আগের সেই সুখ স্মৃতি মনে করে দুইজন ফিরে যান তাদের সেই সময়ে। আক্ষেপ করতে থাকেন নিজেদের ভাগ্য নিয়ে। তখন বাবর তাকে জানান, তার থেকে সে নিজেকেই বেশি অপরাধী মনে করেন। কারণ ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট সফল হতে পারলে তার আর আজকের পরিণতি ভোগ করতে হতো না। হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের সাথে ২১শে আগস্ট পরিকল্পনা করার সময় বাবরকে তারেক বলেছিল, শেখ হাসিনাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার মিশনে সে যদি সফল হয় তবে তার জন্য বিশেষ পুরস্কার রয়েছে দল ও সরকারে। বাবর আপসোস করে বলেন তার এলকার ওই বিএনপি নেতাকে, সেদিন সফল হতে পারলে আজকের এই পরিণতি ভোগ করতে হতো না।
আলোচিত-সমালোচিত লুৎফরজ্জামান বাবরের উঠে আসার গল্পটিও বেশ চমকপ্রদ। আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের এই মাফিয়ার রাজনীতিতে উঠে আসা মূলত তারেক রহমানের হাত ধরে। তারকে রহমান তার সকল অপকর্ম ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতো বাবরের মাধ্যমে।
২০০১ সালের ১লা অক্টোবর নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে বিএনপি জামায়াত জোট। ১০ অক্টোবর বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রীসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জায়গা পান পটুয়াখালি থেকে সংসদ সদস্য হওয়া আলতাফ হোসেন চৌধুরী। তার ডেপুটি হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তারেক রহমানের ঘনিষ্ট ও আস্থাভাজন লুৎফরজ্জামান বাবর। আশির দশকে বিমানবন্দর কেন্দ্রিক চোরাচালানকারীদের নেতা এবং ভয়ঙ্কর স্মাগলার বাবর তারেক রহমানের সকল দুষ্টু কর্মের প্রধান সহযোগি ছিল। এই কারণে তারেক রহমানও তাকে বিশেষ পছন্দ করতো। তৎকালীন জোট সরকারের স্বারষ্ট্রমন্ত্রী সামরিক বাহিনী থেকে আসা আলতাফ হোসেনও বেগম জিয়ার বিশেষ পছন্দের লোক হওয়ায় ক্ষমতার দাপটে সকল জায়গাতে দাপিয়ে বেড়াতেন। সেই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটি মনস্তাত্তিক লড়াই চলতো আলতাফ ও বাবরের মধ্যে। তারেক রহমান চাইছিল স্বারষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকুক তার একক নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু প্রকাশ্যে মায়ের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতেও তার অনীহা ছিল। তাই তারেক রহমান সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে এমন সময় যুবদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত এক শিশুর পরিবারের সামনে শান্তনা দিতে যেয়ে সেই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে বলে দেশব্যাপীর সামনে জাতীয় ভিলেনে পরিণত হয়। এই সুযোগটাই কাজে লাগান তারেক রহমান। জনরোষের কথা বলে মা বেগম জিয়াকে বুঝিয়ে তারেক রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আলতাফ হোসেনকে সরিয়ে দেয়। তারেকের সামনে রাস্তা তখন পরিস্কার হয়ে যায় এককভাবে মন্ত্রণালয়টি নিয়ন্ত্রণ করার। ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে শেষ পর্যন্ত সরিয়ে দেয়া হয় আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে। এর পরেই দৃশ্যপটে সামনের সারিতে চলে আসেন বাংলাদেশের আলোচিত-সমালোচিত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফরজ্জামান বাবর। বাবরকে সাথে নিয়েই তারেক রহমান একের পর তার মিশন বাস্তবায়ন করেন সেই সময়। লুৎফরজ্জামান বাবর যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একক দায়িত্বে ছিলেন সেই সময়েই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচে নারকীয় গ্রেনেড হামলা করা হয় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায়। পরের বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএসম কিবরিয়াকে গ্রেনেড মেরে হত্যা করা হয়। সিলেটের শাহাজালাল মাজারে ব্রিটিশ হাই কমিশনারের উপর গ্রেনেড হামলা, সারা দেশব্যাপী একযোগে ৫শ’র বেশি জায়গাতে বোমা হামলা এবং দেশব্যাপী ভয়াবহ জঙ্গি হামলা বেড়ে যাওয়া এবং জেএমবির উত্থান ত্বরান্বিত হয় বাবর যখন তারেক রহমানের ম্যান হিসেবে এককভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় সেই সময়।